ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

তরুণরা বাংলাদেশকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারবে

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫
তরুণরা বাংলাদেশকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারবে গ্রাফিতি: রাজশাহী, ছবি: সালাহ উদ্দিন

পূর্ববর্তী যেকোনো অভ্যুত্থান বা রাজনৈতিক ঘটনাবলির সঙ্গে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানে নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত হয়েছে।

শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ প্রান্তিক মানুষের প্রচুর উপস্থিতি দেখা গেছে, যা অন্য কোনো সময়ের অভিজ্ঞতার তুলনায় আলাদা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে শহীদদের স্মরণে স্থাপিত স্মৃতিফলকে শ্রমিক, রিকশাচালক, মজুরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের নাম এর প্রমাণ।

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন সরকার পতনের সংগ্রাম করে গেলেও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের দাবি প্রতিষ্ঠা পায়। ওই ব্যবস্থার বিলোপের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হবে। গত ৫৩ বছরের অন্যায় শাসন ও শোষণের জঞ্জাল থেকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছে এই গণ-অভ্যুত্থান।

ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের দাবিটি প্রমাণ করে, সমগ্র দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছে।

প্রান্তিক মানুষের এমন দাবিগুলো এবং তাদের ভাষা যেন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, এমন একটি উদ্যোগ থেকে আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করেছিলাম। বিভিন্ন জনপরিসর, পেশাজীবী গোষ্ঠী থেকে মানুষের বক্তব্য ও দাবি নিয়ে আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ও সমাধানের চেষ্টা করেছি।

অতীতে যেসব অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেগুলো ছিল সংগঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে পরিচালিত। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মগ্রহণের পরই একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পতিত হয়।

প্রায় ২০ বছর পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও বিগত ১৫ বছর আমাদের ফ্যাসিবাদী শাসন ভোগ করতে হলো। তাই আমরা চব্বিশের অভ্যুত্থানের গণদাবি নয়া-রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেশের সাধারণ নাগরিকদের বিবেচনা করতে চাই। জনগণের হিস্যা জনগণের হাতে বুঝিয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। মানুষের দাবি এবং তাদের হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য গণমানুষের একটি পক্ষ এবং একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন, যে দলের মধ্য দিয়ে জনগণের দাবি ও ভাষ্য রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিফলিত হবে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশবাসীকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি, একাত্তর ও নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি এবার আর হবে না।

আমরা স্পষ্ট করে আরেকটি বার্তা দিতে চাই, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের বিচার করার আগে আমরা নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে না। কারণ এই বিচারটিকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হতে না দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ সক্রিয় থাকব। ফ্যাসিবাদের পতনের পর জনবান্ধব রাজনীতির তাগিদ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উন্মেষ। এ জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, জনগণের দাবি ও আহবানকে উপেক্ষা করার আর কোনো সুযোগ নেই। গত ৫৩ বছরে যে সংবিধান দেশের মানুষকে শোষণ করেছে এবং বিগত ১৫ বছরে যে সংবিধানের আশ্রয়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে, আমরা তার পরিবর্তন চাই। এই সংবিধানটি প্রণয়নের সময় একাত্তরের চেতনাকে বাদ দিয়ে একটিমাত্র দলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের আকাঙ্ক্ষাকে এই সংবিধান ধারণ করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন সংবিধানের জন্য একটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তারা এই সংবিধান সংস্কার করতে না পারলে হয়তো একদিন জনগণের সরকার গঠনের পর এই সংবিধান বাদ দেওয়া হবে। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে মত দিয়েছে, সংবিধান সংস্কার করতে পারে নির্বাচিত সরকার, এটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত। এই বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগের যে সংবিধান ছিল, সেটা জনগণের প্রত্যাশার মাধ্যমে বাতিল হয়ে গেছে। জনগণ একটি নতুন সংবিধানের জন্য প্রয়োজনে আবার মাঠে নেমে আসবে। এই লড়াই জনগণ আগেও জিতেছে এবং ভবিষ্যতেও জিতবে।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী,বিভিন্ন ভাষা বা ধারার যে মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিল, তাদের দাবির মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে, আমরা নতুন একটি সংবিধান চাই। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষে নতুন সংবিধানের রূপরেখা বিষয়ক ৬৯টি প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা বলেছি, সংসদ, রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে। ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়ে যাওয়া বিদ্যমান সংবিধানের সবচেয়ে বড় সমস্যা, এই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা এই বিকেন্দ্রীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের মতের প্রতিফলন হবে। ২০২২ সালে প্রণীত আইনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। এটি নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব স্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আইনের বলে যদি একটি নির্বাচন হয়েও যায়, এর মাধ্যমে গঠিত সংসদ জন-আকাঙক্ষা বাস্তাবায়ন করতে পারবে না। এর ফলে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ওপর সাধারণ মানুষের গভীর আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। কারণ জনগণ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক প্রবীণ চিন্তা ও ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করেছে। নতুন পরিবর্তন এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এগিয়ে যেতে যারা অপারগতা প্রকাশ করছে তাদেরও পরিত্যাগ করবে। জনগণ বিশ্বাস করে, তরুণরা বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারবে। সে জায়গা থেকে তরুণদের নতুন একটি রাজনৈতিক দল আসার আকাঙ্ক্ষাও সৃষ্টি হয়েছে। তরুণদের রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পরস্ফুটিত হবে, এটি মানুষের প্রত্যাশা।

আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রাখব, যার মাধ্যমে এই গণ-অভ্যুত্থানের সব অংশীজন তরুণদের দলে উঠে আসবেন। দলীয় ও মতাদর্শিক লড়াইয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের জন্য কাজ করবে, এমন রাজনৈতিক শক্তি আমরা গঠন করব, যেন জনগণের পক্ষে লড়াইকারী একটি শক্তি নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারি। জাতীয় নাগরিক কমিটি এই দল গঠনে মানুষের বোঝাপড়া, দাবি ও ভাষ্যকে একত্রীকরণের কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে, তারা তাদের পক্ষের শক্তিকে চিনে নিতে পারবে।

লেখক: আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি

(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।