ঢাকা, সোমবার, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

সাংস্কৃতিক বিকাশই পারে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে

জাকিয়া বারী মম, অভিনেত্রী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
সাংস্কৃতিক বিকাশই পারে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে গ্রাফিতি : মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ছবি : মোহাম্মদ আসাদ

‘মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি মানুষ মরছে তাও রাজনীতি’

সমস্যা ও সম্ভাবনা : প্রেক্ষাপট পার্বত্য চট্টগ্রামরাজনীতির পরিপূরকতায় মানুষকে এভাবেই দেখেছেন প্রিয় কবি আবুল হাসান। রাজনীতি নিয়ে অনেক মানুষের আগ্রহ না থাকলেও মানুষকে নিয়ে আগ্রহ আছে রাজনীতির।

আর চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান গোটা বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে এসেছে একই পতাকার নিচে। নিজের কাজ নিয়ে মানুষ ছিল ভালো-মন্দ, যদিও পার হতে হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা।


চব্বিশের ১৪ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ইউটোপিয়ান গল্পের শুটিংয়ে সারা রাত জেগেছি, ক্লান্ত তবু অদ্ভুত অবিশ্রান্ত। এমন এক গল্পের চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে রাতভর খোলা কালো আকাশের নিচে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছি। কিন্তু ভাঁজে ভাঁজে স্লোগানে উঠে আসা মশাল মিছিল এড়াতে পারিনি। সারা রাতের সেই ইউটোপিয়ান গল্পে নির্দেশক যে জাদুবাস্তবতা হাজির করতে চেয়েছিলেন, তা গল্প আর রাজনীতি মিলে তৈরি করেছিল এক পরাবাস্তবতা।

ছাত্ররা জেগে উঠেছিল মশালে-মিছিলে-গানে—‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার। ’
এই তো শুরু সেই গণ-অভ্যুথানের, যা বিপ্লব না হলেও বাংলাদেশের গণমানুষের চিৎকার হয়ে উঠেছিল। যে চিৎকার শোষণ, নিপীড়ন, দুর্নীতি আর বাকস্বাধীনতা হরণের বিপক্ষে এ দেশের মানুষের তীব্র প্রতিবাদ। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তর, নব্বই পার করে চব্বিশ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা তৈরি করল।


১৪ জুলাই ছাত্ররা এক হয়েছিল কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজু ভাস্কর্য ঘিরে, যা পরে শোষকগোষ্ঠীর নিপীড়নের মুখে এক দফায় পরিণত হয়েছিল।
সমস্যা ও সম্ভাবনা : প্রেক্ষাপট পার্বত্য চট্টগ্রাম১৪ জুলাই, ১৬ জুলাই, ১৮ জুলাই শহীদ আবু সাঈদ, ফাইয়াজ, প্রিয় থেকে শহীদ মুগ্ধরা দেশের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণে রক্তাক্ত হয়েছে, ঝরেছে সহস্রাধিক তরুণ প্রাণ। যাদের আমরা অনেকেই ভেবেছি প্রযুক্তিতে বুঁদ হয়ে থাকা প্রায় অকার্যকর প্রজন্ম, তারাই আমাদের শিখিয়েছে দেশকে নতুন করে ভালোবাসার মন্ত্র। উনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ের গণজাগরণ দেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু স্মৃতিতে চব্বিশ থাকবে জনজাগরণের দগদগে প্রাণবন্ত চিত্র হয়ে। চব্বিশের স্বতঃস্ফূর্ত জনজোয়ার উঠে এসেছে স্লোগানে, গর্জে উঠেছে গান-কবিতায়, জ্বলে উঠেছে পোস্টারে, প্ল্যাকার্ড আর গ্রাফিতিতে।

এ দেশের মানুষের বুকের মাঝে স্বাধীনতার প্রশ্নে এমন আগুন জ্বলেছে বারবার, এ আমার দেশের সংস্কৃতি, আমার দেশের ঐতিহ্য। স্বাধীনতা থেকে গণ-অভ্যুত্থান—নজরুল ধরে আছে বাংলার হাত। সেই সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় এবারেও নজরুল প্রাসঙ্গিক—

‘গাহি সাম্যের গান—/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ কিংবা ‘বল বীর বল চির উন্নত মম শির’-এর মতো মানুষের জয়গানে। যাত্রাপালা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাহাত্তরে থিয়েটার আন্দোলনে শিল্পীরা যুক্ত হয়েছিলেন দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে। সেই সংগ্রামে পথনাটক, থিয়েটার, সাহিত্য, গান নিয়ে লড়েছেন মমতাজউদদীন আহমদ, সেলিম আল দীন, ফেরদৌসী মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, জ্যোত্স্না বিশ্বাস, অমিত সরকার, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজ এবং আরো অনেক গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তি।

এই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষকদের একাংশ যুক্ত হয়েছিল। যুক্ত হয়েছিল সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ, অভিভাবক, শ্রমিক, সাংবাদিক, এমনকি পথশিশুও। এই সবই কমবেশি আমাদের জানা। কিন্তু এই    গণ-অভ্যুত্থানে এ দেশের মানুষ কী চেয়েছে, কেন এই গণপ্লাবন তা মুখ্য বিষয়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা আছে বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা, যা একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৪ বছরেও সাধারণ মানুষ তা উদযাপন করতে পারেনি, বারবার স্বৈরাচারের দেখা মিলেছে এই বাংলায়। তাই চব্বিশে ছাত্রদের হাত ধরে, প্রযুক্তিকে নির্ভর করে এই গণ-অভ্যুত্থান। প্রযুক্তির এই জাগরণের সময়ে এসে তাই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাই কেবল মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। শারীরিক নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, মুক্তচিন্তার বিকাশ, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার প্রয়োগ, অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক বিকাশও এখনকার বাংলাদেশের মৌলিক চাহিদা।

১০ ডিসেম্বর ২০২৪-এ প্রকাশিত দ্য পোস্টের এক জরিপে দেখা গেছে, স্বৈরাচারের শাসনামলে ২৮ লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, যা ফিরিয়ে এনে দেশের কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন বা সংস্কার করা সম্ভব, যাতে দেশের কৃষিসম্পদ দেশের মানুষের সব চাহিদা মেটাতে পারে, মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে আর পারে মেধাপাচার ঠেকাতে। মহানগরী ঢাকা এবং বাকি সাতটি বিভাগে পাবলিক লাইব্রেরি তৈরির মাধ্যমে মানুষের মেধা বিকাশের কাজ হাতে নেওয়া খুবই জরুরি, যেন আরো ২০ বছর পরে একটা শিক্ষিত জাতি হয়ে উঠতে পারি আমরা।

এর সঙ্গে সিনেমা হল স্থাপন এবং ফিল্ম ইনস্টিটিউট খুবই অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় সংস্কারের মাধ্যমে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি, যা আমাদের সুকান্তের দুর্মর বাংলাদেশে পরিণত করতে পারে। এমনই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের বিস্ময় হতে পারে বাংলাদেশ। সুকান্তের ভাষায়—

‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/অবাক তাকিয়ে রয়/

জ্বলে পুরে-মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়’

এমন সব আশা নিয়ে আবু সাঈদরা বুক পেতে দিয়েছিল পুলিশের গুলির সামনে, দেশজুড়ে আঁকা হয়েছিল গ্রাফিতি, স্লোগানে মুখর হয়েছিল রাজপথ, আবেগে ভেসেছিল সোশ্যাল মিডিয়া।

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করছি, সেই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কী হবে তা না ভেবে ছাত্রদের মৃত্যুতে মুখে শুধু আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠাই নয়; সে অভিজ্ঞতা নিজ পরিবারের এই প্রজন্মের বাচ্চা ছেলেটার পেটে গুলি লাগার সেই রাতের অভিজ্ঞতা।

৪ আগস্ট রাতে জানতে পারি, বোনের ছেলে দীপ্র মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, যার বাবা লে. কর্নেল কাজী রবি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের একজন শহীদ। মেডিক্যালে তাকে দেখতে যাই রাতেই, তখনো সে শঙ্কামুক্ত নয়। অপারেশন লাগবে, কারণ পেটের নিচে গুলি লেগে তা পেটের অন্য পাশ দিয়ে চিরে বেরিয়ে গেছে। ভয়াবহ সেই অনুভূতি। ছাত্র, শিশু, সাধারণ মানুষ মরছিল স্বৈরাচারী শাসকের গুলিতে। তার ওপর যখন সে আঘাত পরিবারের সদস্যের ওপর হয়, তা ব্যাখ্যার অতীত। পর পর একাধিকবার অস্ত্রোপচারের পর এখন সে মায়ের কোলে ফিরেছে; কিন্তু ফিরেছে রক্তাক্ত সেই বেদনা নিয়ে। জীবনের বাজি নিয়ে দীপ্র এবং দীপ্রর মতো হাজারো আহত ছাত্র, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ এখনো লড়ছে বুলেটের স্প্লিন্টার নিয়ে, হাত-পা হারিয়ে, চোখ হারিয়ে। সেইসব বীর যোদ্ধার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এই নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশের পবিত্র দায়িত্ব। বায়ান্নর ভাষাসৈনিকরা, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছিল হায়েনার মুখ থেকে। আর চব্বিশের শহীদ আর বীর যোদ্ধারা সেই বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে লড়েছে, এখনো লড়ে যাচ্ছে। এই বীর সন্তানদের জানাই লাল সালাম।

কবি হেলাল হাফিজ বলেছিলেন—

‘নিউট্রন বোমা বুঝ, মানুষ বুঝ না’

যে মানুষই গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সেই মানুষের চাওয়াকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মানবিক মূল্যবোধ, দিতে হবে নাগরিক ন্যায্য অধিকার। তবে এই হোক আমার শেষ কথা—আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম এই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আজন্ম কৃতজ্ঞ থেকে যেন দেশের ভালোর স্বার্থে কাজ করি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।