ঢাকা, সোমবার, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

রপ্তানি খাত বহুমুখী করতে হবে

আবদুল্লাহ হিল রাকিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
রপ্তানি খাত বহুমুখী করতে হবে

রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য আমরা তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা আরো বাড়ছে।

বর্তমানে এই খাত থেকে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে। একটি জাতীয় রপ্তানি কৌশল তৈরি করে সে অনুযায়ী এগোতে হবে, তা না হলে একক পণ্যের ওপর রপ্তাানিনির্ভরতা কাটবে না।

অর্থনীতির স্বার্থে রপ্তানি খাত বহুমুখী করাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি র‌্যাংকিংয়ের দিক থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি, অর্থাৎ পণ্যে বৈচিত্র্যের সক্ষমতা আমাদের অনেক কম। আমাদের এই সক্ষমতা বাড়াতে সব দিক নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

উদ্যোক্তা তৈরিতে সামাজিক স্বীকৃতি প্রয়োজনআমাদের বেশ কিছু উদীয়মান খাত আছে; যেমন—চামড়াপণ্য, নন-লেদার ফুটওয়্যার, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি, সিরামিকস ইত্যাদি।

এগুলোর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তবে এর জন্য জ্বালানি, আর্থিক, ব্যাংকিং সহায়তা এবং আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে আরো বেশি নীতি সহায়তা প্রয়োজন। ২০২৬-এর পরে কোন বাজারে কোন পণ্য কী ধরনের শুল্ক বাধার সম্মুখীন হবে সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
চলতি বছর আমরা অনেক ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছি।

আমাদের অভ্যন্তরীণ সংকট, বিশেষ করে গ্যাসসংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, শ্রম খাতে অস্থিরতা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মতো বিষয় মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর পাশপাশি সরবরাহ শৃঙ্খলে সংকট, ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয়, বিনিয়োগ মন্থর হওয়া এবং অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে অস্থিরতা চলছে। সব মিলিয়ে আমরা একটি অনিশ্চিত সময় পার করছি।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১১.৭ শতাংশ। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর কোনো প্রবৃদ্ধি নেই।

অর্থাৎ গত তিন বছরের বিচারে পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি শূন্য। আপেক্ষিক মানদণ্ডে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ মাপলে হয়তো সঠিক চিত্র দেখা যাবে না। একটি বছরে কোনো কারণে কোনো দেশের রপ্তানি কম হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরের বছর রপ্তানি স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখায়। ঠিক এর উল্টোটিও হতে পারে।

জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.২৭ শতাংশ। ভারতের ৭.৭৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৯.৯৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ১০.৩২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ২৩.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ের বিচারে আমরা পিছিয়ে আছি। আগে বলেছি, চলতি বছরে আমরা নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি, বছরের শুরুতেই আমরা ৫৬ শতাংশ মজুরি বাড়ালাম, এরপর ফেব্রুয়ারি মাসেই আমাদের রপ্তানি প্রণোদনা ব্যাপক হারে কমানো হলো, সেই সঙ্গে চলছে গ্যাসসংকট ও বন্দর-কাস্টমসের জটিলতা। তারপর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য এই শিল্পের ত্যাগ কম নয়। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকা, কারখানা বন্ধ, সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যস্ত হয়ে পড়া—এসব আমরা দেখেছি জুলাই মাসে। এর পর থেকে শ্রম খাতে অস্থিরতা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকলেও তা শুধু আশুলিয়া ও গাজীপুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। শ্রমিক আন্দোলন সমগ্র শিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং নির্দিষ্ট এলাকা এবং কিছু কারখানা এই অবস্থার শিকার হচ্ছে। শ্রমিকদের কিছু দাবি অযৌক্তিক ছিল। তবু সব কিছু বিবেচনা করে শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থে ১৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি, যার মাধ্যমে শিল্পে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। এই চুক্তির অংশ হিসেবে সরকার শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধিকে ৫ থেকে ৯ শতাংশ করেছে, যা বাজার ও মুদ্রাস্ফীতির কথা বিবেচনা করে শ্রমিকের স্বার্থে আমরা মেনে নিয়েছি। যদিও আমাদের শিল্প বর্তমানে অর্ডার সংকট, মূল্যপতন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ব্যাংকিং সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে, তার পরও যখন আমরা ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির মাত্র ১১ মাসের মধ্যে পুনরায় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, তখন এই ধরনের পরিস্থিতি শিল্প, শ্রমিক বা অর্থনীতির জন্য কোনো স্বস্তির বার্তা বহন করে না। ত্রিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত বৃদ্ধির ঘোষণা সত্ত্বেও শ্রমিকরা আবারও অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছে, এবং এটি বিশেষ করে আশুলিয়া ও সাভারে দেখা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। ঠিক এই সময়ে প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের সেক্টরকে আরো শক্তিশালী করতে কাজ করছে। ইউরোপের সঙ্গে এফটিএ করেছে ভিয়েতনাম। সেখানে আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রভাব মোকাবেলার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ে একটি নজিরবিহীন সংকট পার করছি। আমাদের শিল্পের প্রণোদনা কমানো হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এখন মোকাবেলা করছি ব্যাংকিং সংকট। সব মিলিয়ে প্রবৃদ্ধি সহায়ক কোনো পরিবেশ এ বছর আমরা পাইনি।

শিল্পের নিরাপত্তা, গ্যাস সরবরাহ অবিচ্ছিন্ন রাখা, ব্যাংকিং খাতের সহায়তাসহ বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের খুব দ্রুত উন্নতি দরকার।

আমরা আশা করি, এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও ফেডারেশন নেতারা তাঁদের নেতৃত্বের পরিচয় দেবেন এবং শ্রমিকদের মধ্যে যে আস্থার সংকট আছে তা দূর করতে সবাইকে কাজ করতে হবে। শিল্প বন্ধ হলে সেটি কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না, এটি বোঝাতে হবে। সরল শ্রমিকদের ঘিরে কেউ পরিস্থিতি অশান্ত করছে কি না সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নজরদারি চালাতে হবে। পোশাকশিল্পে সামাজিক সংলাপের গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিটি উদ্যোক্তাকে তাঁর কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে কোনো পরিস্থিতিতে কেউ শিল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়।

রপ্তানি বাড়াতে বৈচিত্র্য জরুরি
বৈশ্বিক পোশাক বাজার অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে, যেখানে শুধু ফ্যাশন বা ট্রেন্ড নয়, বরং পণ্য, কার্যকারিতা, টেকসইতা, ফাইবার এবং সম্প্রতি টেকসই ও পুনর্ব্যবহারযোগ্যতার মতো বিষয়গুলো ফ্যাশন বাজারে বৈচিত্র্য আনছে। আমরা এখন পর্যন্ত পিরামিডের নিচের ধাপেই রয়েছি, অর্থাৎ বেসিক কটন নির্ভর শিল্প এবং টি-শার্ট, ট্রাউজার, সোয়েটার ও ওভেন শার্টে আটকে আছি। তবে গত দশকে আউটার ওয়্যার, ফরমাল ওয়্যার, অ্যাকটিভ ওয়্যার, স্যুট এবং লঁজেরির পণ্যে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এসেছে এবং এসব খাতে রপ্তানি বাড়ছে, নন-কটন পণ্যের অংশ আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের ২৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা কয়েক বছর আগেও ২৫ শতাংশ ছিল। আমি মনে করি, উৎকর্ষের এই দিকগুলোতে সরকারের নীতি সহায়তা পেলে আরো বেশি উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবেন। সেই সঙ্গে বন্দর ও কাস্টমস সম্পর্কিত জটিলতাগুলো কমানো গেলে এবং গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করা গেলে এ ধরনের বৈচিত্র্যময় পণ্য তৈরিতে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারব। পাশাপাশি প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতির বিষয়গুলোতে আমাদের শিল্পের আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ সব সময় তার সক্ষমতা ও সম্ভাবনা কাজে লাগানোর অদম্য শক্তি প্রদর্শন করেছে। তবে সব কিছু বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল।

অবশ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর সময়ে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক পর্যায় এসেছে। আশা করছি, সরকারের নেওয়া সব পদক্ষেপের সুফল পেতে শুরু করলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, বিজিএমইএ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টিম গ্রুপ

(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।