ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন ।। আহমদ রফিক

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৪
ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন ।। আহমদ রফিক

দীর্ঘ সময়ের অচেতন স্তব্ধতার পর প্রাণ স্পন্দনের উষ্ণতায় ফিরতে পারেননি ভাষাসংগ্রামী বন্ধু আব্দুল মতিন। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের সবচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এক অজানা-অচেনা লোকে তার পাড়ি—কারো ভাষায় পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাওয়া।

পরিস্থিতির বাস্তবতা সত্ত্বেও এ চলে যাওয়া আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর।

বন্ধু আব্দুল মাতিন বেশ কিছুদিন থেকেই নানাধরনের অসুস্থতায় ভুগছিলেন, যাকে আমরা বলি বার্ধক্যজনিত রোগ। তারুণ্যে তার প্রধান অর্জন—তার ভাষায় ‘একমাত্র সফল অর্জন’ বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। রাজনীতির কষ্টসাধ্য পথে দীর্ঘ সময় ধরে বিচরণের পরও তার কাছে মনে হয়েছে, ‘ভাষা আন্দোলন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন’।

কেন? কারণ বিষয়টিকে তিনি বাঙালি জাতিসত্তার পাওয়া না-পাওয়া ও ব্যথা-বেদনার সঙ্গে একাত্ম করে নিয়েছিলেন বলে। বামাবর্তে পৌঁছে যাবার আগেই এ আন্দোলনে তিনি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রামী রূপটি দেখতে পেয়েছিলেন। কথা প্রসঙ্গে এ উপলব্ধির কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। এবং বারবার বলতেন।

এর কারণও আছে। বাঙালির জাতীয় জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে ভাষা-আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার অর্জনই নয়, এর সঙ্গে জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কও বেশ গভীর ও তাৎপর‌্যপূর্ণ। তাই আমরা বলে থাকি, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আমাদের জাতীয় রাজনীতির যাত্রাপথ তৈরি হয়েছে। জাতীয় জীবনে ভাষার রাজনৈতিক, সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনাই এমন কথকতা।

দুই.
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যে আন্দোলন, সেই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারিগর ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন। ভাষা আন্দোলেন তিনি এমনভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন যে, ১৯৫০ সালের মার্চে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক হিসেবে পরবর্তী দুই বছরে আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করাই ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। একুশের দামাল দিনগুলোতে এই একই ধারা বিদ্যমান থাকে।  

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ২০শে ফেব্রুয়ারিতে আরোপিত ১৪৪ ধারা ভাঙার (অমান্যের) বিষয়টি। এ ক্ষেত্রেও আব্দুল মতিনের ভূমিকা অনমনীয়। অথচ রাজনীতিক এবং তাদের সমর্থক কয়েকজন ছাত্রনেতার চাপে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যে আপসবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (১১/৩ ভোটে) তার বিরুদ্ধে আব্দুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মাওলার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সেইসঙ্গে ছিল সাধারণ ছাত্রদের সাহসী-স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা।  

এ কারণেই ১৪৪ ধারা অমান্য করে একুশের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল আন্দোলনের যাত্রাপথে এক বিরাট মাইলফলক। তাই বলতে হয় ১৪৪ ধারা ভাঙার মধ্য দিয়ে একুশে প্রকৃত অর্থেই ‘একুশে’ হতে পেরেছিল। আর আন্দোলনে মনপ্রাণ ঠেলে প্রাক-একুশে এবং একুশোত্তর পর্বে আন্দোলনকে শ্রমনিষ্ঠ পথে সার্থকতায় পৌঁছে দেবার কারণে আব্দুল মতিন হয়ে ওঠেন ‘ভাষামতিন’।

তিন.
ব্যক্তি আব্দুল মতিন, ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন, রাজনীতিক আব্দুল মতিন জীবনের সততা ও রাজনৈতিক সততার এক আদর্শ উদাহরণ রেখে গেছেন। এ উদাহরণ রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিরল ঘটনা। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকেও মত ও পথের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করার মতো নির্ভীক সৎসাহস তার ছিল। এ দিক থেকেও তিনি অনন্য।

আজই একজন প্রশ্ন করেছেন, তার প্রস্থানের শূন্যতা কিভাবে পূরণ হবে? যুক্তি বলে, বিশ্বভুবনের কোথাও শূন্যস্থান অপূর্ণ থাকে না। তা নিয়মমাফিকই পূর্ণ হয়। তবে একে কিভাবে কাজের মাধ্যমে পূর্ণ করতে হয় সেটাই কথা। সেখানেই যত সমস্যা।

ভবিষ্যৎশুদ্ধ তারুণ্যের ওপর আমাদের ভরসা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।



আহমদ রফিক: ভাষা সৈনিক




বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।