ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

যন্ত্রণার ভাষা ও বোধ একই ধরণের

লতিফা নিলুফার পাপড়ি, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩১ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১১
যন্ত্রণার ভাষা ও বোধ একই ধরণের

ঢাকা: কিছু কথা থাকে যার কোনো শিরোনাম দেয়া যায় না। তেমনি কিছু দুঃখ-কষ্ট মানুষকে হতবাক করে দেয়।

সব যন্ত্রণার ভাষা ও বোধ একই ধরণের হয়। এতদিন আমরা দেখেছি, সমাজের বখে যাওয়া মাদকাসক্ত যুবক প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তার প্রেমিকাকে অথবা যৌতুকের জন্য তার স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছে। আমরা সবাই তার কঠোর শাস্তি দাবি করেছি।

কিছুদিন তার বিচার চেয়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেছি। কখনও বিচার হয়েছে কখনও বা হয়নি। আমরা এ ঘটনাকে অস্বাভাবিক কিছু ভাবিনি। কারণ, বখে যাওয়া সেই যুবককে আমরা ঘুণে ধরা সমাজের পঁচা অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছি। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন জনমত জরিপ কোনো বিষয়ই না।

আমার ধারণা, এইচএসসি পাস করেছেন এমন মেধাবী শিক্ষার্থীদের ১০০ অভিভাবককে যদি আমরা জিজ্ঞেস করি, আপনার সন্তানকে কোথায় ভর্তি করাতে চান?  আমার বিশ্বাস, ৯০ ভাগ অভিভাবকের কাছ থেকেই উত্তর আসবে তারা তাদের সন্তানকে বুয়েট কিংবা অথবা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে চান। বুয়েট পাস করা (যদিও এখন শোনা যাচ্ছে কেবল এইচএসসি পাস) আমাদের সেই মেধাবী সন্তানগুলো কেন সত্যিকারের মানুষ হয় না?

১৪ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরকে নির্যাতনের খবর যখন কাগজে পড়লাম। তখন আমার কাছে মনে হলো-তিনি হয়তো আবেগের বশে কোন মাদকাসক্ত ভবঘুরে যুবককে বিয়ে করেছিলেন। নেশার টাকার জন্যই তিনি হয়তো রুমানাকে নির্যাতন করেছেন।

কিন্তু, হায় কপাল! শোনা গেল সেই নিপীড়ক স্বামী নাকি বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলী? আমরা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেধাবী সন্তানটিকে প্রকৌশলী কিংবা ডাক্তার বানালাম, কিভাবে মেনে নেব যে, সে মানুষ হয়নি ? এই যন্ত্রণা আমরা রাখবো কোথায়?

আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে দোষ দিই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাটাও কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়েই তৈরি করেছেন। নিজের ছেলে সন্তানটিকে কান্না করতে দেখলে আমাদের অনেক মা-বাবাই বলেন- ‘ছি ! বাবা, কান্না করো না; তুমি না পুরুষ মানুষ। ’ আর স্ত্রীর চোখের জল অনেক পুরুষের কাছেই আকাঙ্খিত বস্তু। সেই সন্তান- ছোট বেলা থেকেই দেখছে মায়ের চোখের জল ও বাবার বিজয়ভঙ্গি। তার কাছে কিভাবে আমরা আশা করবো নারী অধিকার?

পুরুষ আর নারী তো আমরাই বানাই। আমরাই তো মেয়ে শিশুকে মাথা নত করে চলতে ও নিচু গলায় কথা বলতে শেখাই। আর ছেলে শিশুকে শেখাই মাথা উঁচু করে চলতে। তার দরাজকন্ঠ আমাদের আশ্বাস দেয়, সে বড় হয়ে কিছু একটা হবেই।

রুমানা মনজুরের মেয়ে আনুশেহ’র কথা পড়ে। মনে পড়ে তানভিরকে। তানভির ছিলো তার মায়ের খুনের প্রত্যক্ষদর্শী। তানভিরের স্বাক্ষীতেই তার মায়ের খুনির শাস্তি হয়ে ছিলো। সেই খুনি ছিলো তার বাবা !

আনুশেহ’র চিন্তাটা আমাকে তাই সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয়। যে মা-বাবা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়, কেন তাদেরই কেউ কেউ তার সন্তানের চোখের সামনে কালি মাখে? ১৯ জুন গেল বাবা দিবস। বাবা দিবসে কি বলে আনুশেহ তার বাবাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে (!) জানতে বড় ইচ্ছে করে?

ধর্ম ব্যাপারটা বেশিরভাগ প্রগতিশীলদের কাছে যেমন উপেক্ষিত তেমনি পাঠ্য বিষয় হিসেবেও অনেকটাই উপেক্ষিত। এনসিটিবি’র প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্ম বইগুলোর শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা, সততা ইত্যাদি বিষয়ে পাঠও তাই উপেক্ষিত থেকে যায়। আমার বিশ্বাস পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং একে অন্যের প্রতি সহনশীলতা থাকলে কোন সম্পর্কই এত তিক্ত হতে পারে না।

রক্তসম্পর্কহীন নর-নারী যখন স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হন, সে সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা অত্যাবশ্যকীয়।

ভালবাসা, বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়গুলো, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে থাকলে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা কোনো ভাবেই ঘটতে পারে না। তাই নীতি শিক্ষা নিয়ে আলাদা পাঠ্যবিষয় হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে নীতি শিক্ষা পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তা ফলপ্রসূ করতে পারলে আমরা আমাদের সন্তানকে মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারবো।

এখন বিশ্বায়নের যুগ। তাই দরজা বন্ধ করে নিজের ভুল রুখার চিন্তা বোকামি। তেমনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশ্রণে ডিজিটাল সন্তান তৈরির চিন্তাও বোকামি। আমাদের ঢাল-তলোয়ার হলো আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ যদি আমরা আমাদের সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি, তাহলে আমরা এ ধরণের অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো কিছুটা হলেও রুখতে পারবো।

ছোট বেলায় এক আত্মীয়ার বাঁধাই করা সূচিকর্মে স্বর্গ-নরক কবিতার লাইনগুলো না বুঝেই মুখস্ত করে ছিলাম।

 ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক/ কে বলে তা বহুদূর?/ মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক/ মানুষেতে সুরাসুর। / রিপুর তাড়নে যখনই মোদের/ বিবেক পায়গো লয়/ আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়/ প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে/ যবে মিলি পরস্পর/ স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন/ আমাদের কুঁড়ে ঘর। ’

এখন যখন কবিতার এই কথাগুলো বুঝি, তখন দেখি এগুলো খুবই বাস্তব।
 
লেখক: শিক্ষক, কলাম লেখক, কবি ও গল্পকার।

বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘন্টা, জুন ২৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।