সেঁজুতিকে নিয়ে সুমি খানের লেখাটা পড়ে আঁচড় কাটল মনে। তার সঙ্গে কথা বলার লোভ সামাল দিতে পারিনা।
ফেসবুকের প্রোফাইলে গিয়ে ইনফো থেকে নাম্বার বের করে ফোনে তার লেখার প্রশংসা করি। ওপাশ থেকে বারবার করে পরিচয় নিশ্চিত হতে চাইছিলেন সুমি। মজা করে বলি আপনার ভক্ত। এত ভক্ত আপনার, নাম বললে কি চিনতে পারবেন! পরিচয় জানাজানি হাসাহাসির পর তার লেখার দৈর্ঘ নিয়ে প্রথম আলাপ করি। আমার চিরদিনের বদনাম ছোট করে লিখতে পারিনা। পত্রিকা অফিসে এ নিয়ে অনেক সমস্যা হতো। কারেন্ট বিটের অনিবার্য রিপোর্টটির জায়গা করতে গিয়ে অনেক সহকর্মীর রিপোর্ট বাদ অথবা এক্সেসহয়ে যেত।
সুমি বলছিলেন লেখার দৈর্ঘ নিয়ে তিনিও চিন্তায় ছিলেন। আলমগীর ভাই’কে (আলমগীর হোসেন, এডিটর ইন চীফ, বাংলানিউজ) বলছিলেন, এত বড় লেখা তিনি জায়গা করতে পারবেন কীনা! অনলাইন নিউজপোর্টালের এটিই বুঝি বাড়তি সুবিধা! দেশের কোন প্রিন্ট মিডিয়া এত বড় জায়গা দিত বা লেখাটা ছাপত কিনা সন্দেহ! কারন সেই যে, কাক কাকের মাংস খায় না! সেঁজুতিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমাদের মিডিয়ার অন্দর মহলের কুৎসিত অনেক কিছু লিখে ফেলেছেন সুমি খান। জানিনা এরজন্য কী মাশুল তাকে গুনতে হয়!
সেঁজুতির কথা লিখেলেও সুমি প্রণতির কথা লিখেননি। প্রণতিকে তিনি চেনেন জানেন কিনা জানিনা। সেঁজুতি-প্রণতি দুইবোন আমাদের কাছে রেখে যাওয়া সহকর্মী শহীদ সাংবাদিক শামছুর রহমানের স্মৃতি। রিপোর্ট লেখার টেবিলেই খুন হয়েছেন তাদের বাবা। একটা কথা জোর দিয়ে বলি তাহলো, গত কয়েক বছরে দেশে যত সাংবাদিক খুন হয়েছেন, তাদের মধ্যে সরাসরি রিপোর্টের কারনে খুন হয়েছেন শামছুর রহমান আর ফরিদপুরের গৌতম।
যশোর-খুলনা অঞ্চলের মানুষজন বা অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সাংবাদিকদের কাছে শামছুর রহমান শুধু ‘কেবল’ অথবা ‘কেবল ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। ঢাকার বাইরে থাকা কেউ তার সময়ে এত পড়াশুনা আর শুদ্ধ রিপোটিং পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতেন তা মোনাজাতউদ্দিনের পর আর দেখা যায়নি। মোনাজাতউদ্দিন তার নিজস্ব বৈশিষ্ট আর অনুসন্ধান-উপস্থাপনার গুনে মফঃস্বল রিপোর্টকে পত্রিকার প্রথম পাতায় নিয়ে আসেন। আর শামছুর রহমান প্রতিষ্ঠিত করেন ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের আধুনিক মনস্ক রিপোর্টিং’এর যোগ্যতা আর তাদের প্রাতিষ্ঠানিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব। সে কারণে তিনি সম্ভবত ওয়েজবোর্ড অনুসরণ করা দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে প্রথম স্পেশাল করসপন্ডেন্ট। কাকতালীয়ভাবে মোনাজাতউদ্দিন, শামছুর রহমান দু’জনেই জনকন্ঠে কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেছেন। জনকন্ঠ কর্তৃপক্ষ তাদের মৃত্যুর পরও উভয়ের মাসিক বেতন পরিবার দুটিকে টানা পাঁচবছর দিয়ে গেছে। এমন ঘটনা ঢাকার মিডিয়ায় আর ঘটেছে কিনা জানিনা।
শামছুর রহমানের হাতে কখনো কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ওঠেনি। এরপরও নিজস্ব যে লাইব্রেরি-তথ্যশালাটি তিনি গড়েছিলেন সেটি এককথায় অনন্য। আমাদের রিপোর্টিং’এর জন্যে কোন তথ্যের দরকার হলে তাকে ফোন করলে তিনি কিছু সময়ের মধ্যেই ফ্যাক্স করে দিতেন। এরকারনে তাকে বলা হতো দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সাংবাদিকতার চলমান কম্পিউটার। শামছুর রহমান খুন হবার রাতে বিবিসির ঢাকা অফিস থেকে ফোনে জানতে চাওয়া হয়, গত কয়েকবছরে এমন ক’জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। বিনীত জবাবটি ছিল, এমন তথ্যের দরকার হলে আমরাতো শামছুর রহমানকেই ফোন করতাম।
ভারতীয় রাজনীতির ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য দখলের কারণে ভারতীয় নির্বাচনের রিপোর্ট কভারে তিনিই ছিলেন পত্রিকা কর্তৃপক্ষের প্রথম পছন্দ। চরমপন্থী-চোরাচালানি-মাদক ব্যবসায়ীদের চারনভূমি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রক্তাক্ত জনপদের জঙ্গলে থেকে বাঘের সঙ্গে লড়াই করতেন শামছুর রহমান! ওই জনপদের সে সবকিছুর স্থানীয় রাজনীতিক-সাংবাদিক নামধারী অনেক দূর্বৃত্তও জড়িত ছিলেন, এটির কারণে বরাবর তার জীবন ঝুঁকিতে থাকত। রিপোর্টে ক্ষুদ্ধ বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলাম কিভাবে তাকে খুন করানোর ফন্দি আঁটছিলেন, তা নিজের ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন। তদন্ত পাওয়া গিয়েছিল তরিকুল ইসলামের সাবেক এক দেহরক্ষী রূমে ঢুকে শামছুর রহমানকে গুলি করেছিল। চার্জশিটে যাদের নাম দেওয়া হয় তারা যশোর-খুলনার আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং সাংবাদিক নামধারী একাধিক দূর্বৃত্ত।
কিন্তু ২০০০ সালের ১৬ জুলাইর সেই হত্যাকান্ডের আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তরিকুল ইসলাম বিচার ঠেকিয়ে দেওয়ার যে প্যাঁচ লাগান, আওয়ামী লীগ আজ পর্যন্ত সে প্যাঁচ খুলতে পারেনি অথবা অত আগ্রহ নিয়ে চেষ্টাও করেনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে কাজটি করেছেন তাহলো বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের মাধ্যমে সেঁজুতি-প্রণতির পড়াশুনার খরচের ব্যবস্থা। শামছুর রহমান খুন হয়ে যাবার পর দুই বাচ্চাসহ মিসেস শামছুর রহমান তথা সেলিনা আখতার লাকি ভাবী যে অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জনকন্ঠ কর্তৃপক্ষ, বিবিসির বাংলা বিভাগ সহ অনেকে সহযোগিতার হাতটি না বাড়ালে খুব সমস্যা হয়ে যেত। কারন শামছুর রহমান নিজস্ব যশ ছাড়া পরিবারের জন্যে কিছু রেখে যাননি বা সে চেষ্টাও করেননি।
সেঁজুতি সাংবাদিকতায় আসবে এটি শামছুর রহমানের স্বপ্ন ছিল । সে যখন ঢাকায় সাংবাদিকতায় পড়তে আসে আমি তখন চলে এসেছি অস্ট্রেলিয়ায়। সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতে আগ্রহের কথা জানালে যাদের ফোন করেছি তারা তাকে সুযোগ দেননি। এরপর অনেকদিন তার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়নি। মাঝে কিছু নেতিবাচক খবরও দেওয়া হয়েছে। সুমি খানের লেখার তথ্যে তার মতোদের কিছু কঠিন এবং বিশ্রি অভিজ্ঞতার কথা আছে। দেশের মিডিয়ার যা বিচ্ছিন্ন খবর পাই তা পড়ে-জেনে অবাকও লাগেনি।
মিডিয়া বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার কোন বিচ্ছন্ন দ্বীপ নয়। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজের যত সব নৈরাজ্য-অবিচার, মানুষকে ঠকানো অথবা দাবিয়ে-ঠেকিয়ে রাখা এসব মিডিয়ার মানুষজনকেও গ্রাস করে এবং করেছে। সেই অভয়নগরের প্রতিনিধির পদ থেকে সেঁজুতির বাবা যে সংগ্রামে মিডিয়াতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে এসব চেয়ারবাজরা জানেওনা।
আরেকটি ধারনার কথা সুমি খানকে বলেছি। ক্রিয়েটিভ মিডিয়ার লোকজনের পড়াশুনার পাশাপাশি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা ভালো। সাংবাদিকতায় আমাদের আগের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ফসল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ফসল আমাদের প্রজন্ম। এরপর সে রকম রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন দেশে না হওয়াতে পরবর্তি অনেকের পোড় খেয়ে গড়ে ওঠা হয়নি। তাদের অনেকে স্রেফ খেপবাজ সুবিধাবাদী-সুবিধাভোগী।
আর গত কয়েক বছরে মিডিয়ায় আরও বিস্তর কালো টাকার প্রবেশের সঙ্গে সাংবাদিক-মিডিয়াকর্মীদের হাইজাম্প-লংজাম্পের প্রবনতা-প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। আর বেড়েছে গুতোগুতির নোংরামি। কে কিভাবে কাকে গুতো মেরে বের করে দেবেন! দেশের অর্থনীতি বিশৃংখল আর উপচানো কালোটাকার দাপটের কারনে বলা হয় এখন যে যত বড় সাংবাদিক সে তত বড় কালো টাকার পাহারাদার!
নানাকারনে দেশের মানুষের কাছে মিডিয়ার সিংহভাগ মানুষেরা আজ পাবলিকলি দুর্নীতিগ্রস্ত চিহ্নিত। গণতন্ত্রের শতফুল ফুটতে দেবার বাতাবরনে প্রকৃত মিডিয়ার চাইতে আগাছা-আবর্জনা বেশি হয়ে গেছে। অস্ট্রলিয়ার মতো প্রায় শতভাগ শিক্ষিত মানুষের দেশের প্রধান শহর সিডনি থেকে মাত্র তিনটি দৈনিক বেরোয়। এগুলোই ঠিকমতো চলছেনা। সেখানে বাংলাদেশে যে যেনতেন এত মিডিয়ার জন্ম দেয়া হয়ে গেছে এগুলো ঠিকমতো চালানোর মতো বিজ্ঞাপন- বাজার বা উপযুক্ত লোকবল কোথায়। দেশের কয়টা মিডিয়া মিডিয়া এর লোকজনকে জীবন ধারনের মতো বেতন-ভাতা নিয়মিত দেয়? নিয়মিত বেতনভাতা ছাড়া বিশাল বিশৃংখল এই মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের চলে কী করে?
দেশের চলমান মিডিয়া পরিস্থিতিতে সেঁজুতিদের সংগ্রাম, বোধ, পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ-আক্ষেপ সবকিছুই ভিন্ন। বাংলাদেশের মতো দেশে আবার মেধা-যোগ্যতা এসবের চাইতে কাজের বাজারে মানুষ দুই জাতের। পুরুষ মানুষ-মেয়ে মানুষ! সেঁজুতিরা মেয়ে মানুষ হওয়াতে তাদের সংগ্রাম এবং অর্জনের অভিজ্ঞতাটিও ভিন্ন।
দেশটা সো-কল্ড হাসিনা-খালেদার রাজত্বের হলেও সমাজটা ভিতর থেকেই যেমন পুরুষতান্ত্রিক, দেশের আর সবকিছুর মতো আমাদের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিও পুরুষতন্ত্রের কব্জায়। এটি আমাদের পরিবার থেকে সবখানেই হাত বাড়ানো। এমন একটি সমাজে পুরুষ হয়ে জন্মানোর সুবাদে পরিবারেও আমরা ছেলেরাই একটু বেশি প্রিভিলেজ পাই। অনেকক্ষেত্রে মায়েরাই তা ঠিক করে দেন। আর একটু আলাদা কন্ট্রোলে টাইট দিয়ে রাখেন মেয়েকে । চিন্তাটি এমন নইলে মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে! ছেলেরাতো নষ্ট হয়না। খালি তুলসিপাতা হয়! মেয়েটেয়ে সুবিধামতো পেলে একআধটু ট্রাই করে দেখি আর কী! আর আমরা কী রকম ফুলের মতো পবিত্র তা নিজেরাই জানি। সে কারনে একই পরিবারের সদস্য আমরা ছেলেরা বাইরে একটার পর একটা প্রেম করে বেড়ালেও সারা সময় খেয়াল রাখি আমার বোনটা যাতে প্রেম না করে!
তসলিমা নাসরিন যা লিখেছেন এর অনেককিছুই আমরা ছেলেরা আড্ডায় গল্প করি। কিন্তু তসলিমা নাসরিন লিখাতেই আমাদের মাথা খারাপ হয়! বেয়াদপ মেয়ে মানুষ হয়ে এসব লিখবে কেন? নষ্টা মেয়ে! এমন একটি সমাজের অংশ মিডিয়াও কোন বাইরের জগৎ নয়।
অনেক বছর আগে একবার পাকিস্তানের নির্বাচন কভার করতে গিয়ে ইসলামাবাদের মিডিয়ায় মেয়ে রিপোর্টারদের সংখ্যা দেখে চমকে উঠি। পরবর্তিতে ভারত, মিশর-জর্দান সহ আরও কয়েকটি দেশে গিয়েও প্রেসকনফারেন্স, মাঠেঘাটে গিয়ে দেখি মেয়েরা রিপোর্টিং’এ অনেক তুখোড় এগিয়ে। ঢাকায় তখনও মাহমুদা চৌধুরীদের মতো হাতেগোনা এক-দু’জন মাত্র এ্যাসাইনমেন্ট কভার করেন। মিডিয়ায় নারী কর্মী মানেই তখনও যেন শুধু ডেস্কের লোকজন। বসে বসে অনুবাদ, রেডিও মনিটর করা অথবা বাচ্চাদের-মেয়েদের পাতা দেখা।
বাচ্চাদের পাতাতেও আবার দাদাভাই, দাদুভাই, ভাইয়া এসব পুরুষ চরিত্রের দাপটের কারনে নারী কর্মীদের কাজ ছিল তাদের এ্যাসিস্ট করা বা ফাই ফরমাশ খাটা। একমাত্র সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমদের মতো লোকজনই মেয়েদের আলো দেখাবার যে কাজটি সেই সময়ে করেছেন, সে দৃষ্টান্ত এখনও তেমন নেই। কবি সুফিয়া কামাল প্রথম বোরকা পরে সওগাত অফিসে যান। নাসির উদ্দিন তাকে বোরকা খোলার অনুরোধ করে বলেন, বোরকা পরে কবি হওয়া যায়না। কবি হতে গায়ে একটু আলোবাতাস লাগানো লাগে। এখানকার চেয়ারবাজ অনেকের মতো ব্রা খুলতে বলেননি।
মনে থাকতে থাকতে গোধুলির কথাটা লিখে নেই। ফারজানা গোধুলি। এখন সিএনএন’র সঙ্গে কাজ করেন। ঢাকায় যে দু’একজন মেয়ে প্রথম ফটো জার্নালিজমে আসেন গোধুলি তাদের একজন। মাঠে দেখতাম ফটোসাংবাদিকদের বেশিরভাগ গোধুলিকে দেখতে সহ্য করতে পারেননা। কারন কি? দু’একজনকে জিজ্ঞেস করলে জবাব আসে, বেয়াদব, বেশি ফার্স্ট! জুয়েল সামাদের সঙ্গে গোধুলির এ্যাফেয়ার গড়ে উঠলে এটিকেই অপরাধ হিসাবে দেখা হয়! যেন গোধুলি মেয়ে বলে কাকে সে পছন্দ করবে না করবে সেটিও তারা ঠিক করে দেবে! এসব গায়ে না মেখে তারা দু’জন বিয়েও করেন।
এএফপির ঢাকা অফিসের দায়িত্ব গোধুলির ওপর ছেড়ে জুয়েল যখন ইসলামাবাদ, আফগানিস্তান, জাকার্তার মতো ভেন্যুতে পোষ্টিং নিয়ে চলে যান, তখনও এদিকটা সামাল দিতে নানান অসযোগিতায় গোধুলিকে কষ্টে অনেক কিছু সামাল দিতে হয়েছে। সেই গোধুলি-জুয়েল দম্পতির ঠিকানা এখন হোয়াইট হাউস। এএফপির হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আর মিশেল ওবামার ছবি তোলেন জুয়েল। সিএনএন’র সঙ্গে কাজ শুরু করেন গোধুলি। আর যারা সারাক্ষণ আদাজল খেয়ে গোধুলিকে ঠেকানোর পরিশ্রম করতেন তাদের কথা বলে দূঃখ না বাড়ানোই ভালো! আবার মেয়ে হওয়াতে ছেলে সহকর্মীর তুলনায় বিশেষ কায়দায় বাড়তি সুযোগ সুবিধা নেবার ঘটনা-অভিযোগওতো আছে।
সেঁজুতি একটি স্কলারশীপে জার্মানি চলে যাচ্ছে শুনে সুমি খান ব্যথিত হয়েছেন। তার লেখার নিচের মন্তব্যগুলোতে অনেকে বিষয়টিকে পলায়ন উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়টিকেও আমরা একটু পজিটিভ ভাবে দেখি না কেন। এমনি আমি ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিকদের বেশি বেশি বিদেশ যাবার পক্ষে। এতে প্রথম উপকারটি হয় আমরা নিজেদের ওজন করতে শিখি। এমনিতে আমরা যারা ঢাকায় থেকে প্রধান মিডিয়াগুলোতে কাজ করি, প্রতিদিন পত্রিকায় নাম ছাপা হয় বা স্ক্রীনে চেহারা দেখা যায়, এসবের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে একধরনের ‘হামসে বড়া কোন হ্যায়’ জাতীয় ভাবেরও সৃষ্টি হয়।
কিন্তু বিদেশের ভিন্ন পরিবেশের মাটিতে পা দিতেই আমরা নিজেদের ওজন-আন্দাজ টের পাই! আমরা কে, কারা, ঘটিতে মাল কতটা আছে না আছে ইত্যাদি। এমনিতে দেশে আমাদের অনেকের দুনিয়া মানে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট বা রাজশাহী। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! এরবাইরেও যে দুনিয়া আছে, সেটিও অনেক সাজানো সুন্দর এবং কঠিন, বিদেশ না গেলে এসব চোখ খোলেনা। দেশটা যে এখনও কত সহজ, কম প্রতিযোগিতার, সমান ভাষা-সংস্কৃতির, ইচ্ছে হলে মন খুলে যে একটা গালি কাউকে দেয়া সম্ভব, এ বোধগুলো বিদেশ না গেলে সেভাবে অনুভব করা যায়না। বিদেশ গেলে আরেকটা অনুভব হয়, তা দেশের প্রতি অকৃত্তিম টান, ভালোবাসা। দেশের জন্য প্রতিদিন আমরা বিদেশে বসে কাঁদি। সেঁজুতিরও এ বোধগুলো হবে।
আর বিদেশে নতুন অনেককিছু শিখবে জানবে-সেঁজুতি। এগুলো তার ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। মুগ্ধ হয়ে দেখবে ইউরোপের পড়াশুনাটা কত সাজানো-গোছানো, কোথাও এক রত্তি মেদও নেই। বিদেশে আবার একজন শুধু স্কলারশিপের টাকায় ভালো চলতে-ফিরতে পারেননা। ভালো চলতে সেঁজুতিকেও কোন একটা কাজ করতে হবে। কী সে কাজ? সেঁজুতি এখন যা ভাবতে পারবেনা। দেশের শ্রেনীবৈষম্য শেখানোর মুখস্ত সিলেবাস এসব আমাদের কখনো ভাবতে শেখায়নি।
ঢাকার বিশেষ কারো প্রতি রাগে-ক্ষোভে অথবা কষ্টে সেঁজুতি সুমি খানকে বলেছে, আর কোনদিন সে দেশে ফিরবেনা। এ তার রাগের কথা। অভিমানের কথা। দেশে তাকে ফিরতেই হবে। মিডিয়াতে ফিরতে চাইলে ফিরতেই হবে সেঁজুতিকে। সে ফিরবেই। কারন মিডিয়া তার রক্তে। খুব ভালো একজন সাংবাদিক, সৎমানুষ ছিলেন তার সাংবাদিক পিতা। দেশে তার দুঃখিনী মা, বোন প্রণতি থাকবে। মন থাকবে যশোরের কারবালা গোরস্তানে। সেখানে শুয়ে আছেন তার নিহত সাংবাদিক পিতা। মায়ের জন্য, বোনের জন্য, বাবার কবর ছুঁয়ে দেখার জন্যেও তাকে দেশে ফিরতে হবে। যশোরের মনিরামপুরের সাগরদাড়ি গ্রামের মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ও ফিরেছেন। সেঁজুতিও ফিরে আসবে।
সুমি খানকে তাই অনুরোধ করছি সেঁজুতিকে হাসিমুখে যেতে দিন। এয়ারপোর্টে তাকে আপনিই সি-অফ করবেন। যেদিন ফিরে আসবে রিসিভ করবেন আপনিই। সেখান থেকে সোজা তাকে নিয়ে যাবেন আপনার রণাঙ্গনে। যে রণাঙ্গনে আপনিও লড়াই করছেন। আপনিও খুব ভালো নেই বলেইতো এভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। সেঁজুতিও পালিয়ে যাচ্ছেনা। একটু বিশ্রাম, পড়াশুনা আর শক্তি সংগ্রহের জন্য যাচ্ছে আমাদের সেঁজুতি।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময় ০৭৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১১