ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমি রাজী, আপনারা?

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১১
আমি রাজী, আপনারা?

সৎ ও আন্তরিক যেকোনও উচ্চারণ হৃদয়গ্রাহী হয়। পাঠকের চিত্তাকর্ষণ করে।

ইদানিং সম্ভবতঃ একারণেই সুখপাঠ্য লেখক হুমায়ূন আহমদের লেখাগুলোর ’প্রেমে’ পড়ে যাচ্ছি। নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন হুমায়ূনের লেখাগুলো একার্থে মাইন্ড ব্লোয়িং। ভেতরটা ভাসিয়ে দিয়ে যায় বেদনার অদ্ভুত প্লাবনে! নিজেকে কেন জানি না অজানা কারণেই গিল্টি বোধ করি। মৃত্যুকে মালুম হয় ‘ফাজিল’ এক উপদ্রব বলে। আগে মৃত্যুভীতিতে কাতর হতাম। এখন সেই ভীতিটা দিব্যি উধাও। মৃত্যুর আলিঙ্গন-অপেক্ষাকে মনে হয় অতি পরিচিত কোনো প্রতীক্ষা!

নিজ মৃত্যুকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার জন্যে চাই জোর মানসিক শক্তি। অবিশ্বাস্য সততা। হুমায়ূনের রসবোধ সর্বজনস্বীকৃত। অসুস্হ অবস্হায় এই রসবোধ আরো বেড়েছে জীবনের নির্মম সত্যের মুখোমূখি হবার কারণে। হাজারো ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাঝে হুমায়ূন আক্ষেপ জানিয়েছেন, জন্মভূমি বাংলাদেশে কেন  আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার হাসপাতাল নেই? অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এই আক্ষেপ ও জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের ভেজাল খাবার, বসবাস-অযোগ্য পরিবেশ আর আত্মঘাতী লাইফস্টাইল ক্যান্সারের বিস্তারে রাখছে প্রলয়ংকরী অবদান। ফি বছর ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে সামর্থ্যবান মানুষেরা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খর্চা করে ছোটেন বিদেশে। সামর্থ্যহীনেরা বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের  কাছে পাতেন হাত। ঋণ নিয়ে কাছাকাছির কলকাতাও হলেও সান্ত্বনার অন্তিমযাত্রায় ছোটেন।

টাকার অংকে আরোগ্যলাভের ক্ষীণ সম্ভাবনার মরণঘাতী এই চিকিৎসার হুন্ডি ব্যয় বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশী। সঙ্গে আছে যাতায়ত ও সহায়তাকারীদের আনুষঙ্গিক খর্চা। সেই অংকটাও হেলার নয়। সব মিলিয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার জমজমাট হুন্ডি বাণিজ্যে ক্যান্সার চিকিৎসা প্রদানকারী দেশগুলো দিব্যি আরাম আয়েশে থাকে। দু’হাজার এক সালে ব্যাংককে বাঙালি পর্যটকেরা ছিলেন ব্যয়ের তালিকার দ্বিতীয়। শীর্ষ স্হানের জাপানীরা ব্যাংককে আসতেন নিছক পর্যটনের মানসিকতায় আর বাঙালিরা টুরিস্ট ভিসায় যেতেন চিকিৎসায়।

হালে দেশে অনেক নামীদামী হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলোর খায়-খর্চা ব্যাংকক-চেন্নাই-দিল্লীর বিলের দ্বিগুণ ছাড়ানো আর্থিক যাতনা। কিন্তু বিপরীতে চিকিৎসা ও সেবার মান  প্রশ্নাতীত হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ দেশে একটা আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। হুমায়ূনতো রাজনীতিবিদ কিংবা দেশের নীতি নির্ধারক নন। যারা রাজনীবিদ তাদের ট্যাঁকের জোর অনেক। সামান্য সর্দি-কাশিতে ওনারা উড়াল দেন বিদেশে। ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী ব্যাধিতে নীতি নির্ধারকেরা অবলীলায় বিদেশে বাড়ি-ঘর কিনে থিতু হয়ে চিকিৎসা সারবেন। সেকারণেই দেশে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল তাদের ’পঞ্চবার্ষিকীতে’ নেই। যদি থাকতোও তাহলে আলোর মুখ দেখতে লেগে যেতো দীর্ঘ সময়। এক সরকার নিজের দলের প্রধান বা নেতার নামে গড়তেন হাসপাতাল। অন্য দল ক্ষমতায় এসে সেই নামকরণের ’অপরাধে’ সেই হাসপাতালকে করতেন বেমালুম অবজ্ঞা।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের বর্তমান পর্যায় কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠি ও প্রতিষ্ঠানের একক ও সম্মিলিত উদ্যোগের অবদান। আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার হাসপাতালও হতে পারে সেই ধরণের কোনো ব্যক্তি উদ্যোগে। ’শুঁটকির’ শেয়ারবাজারে `বিড়ালের’ পাহারাদারির কারণে শেয়ার বাজারের মাধ্যমে টাকা তোলার দাবি জানাই না; টাকা তোলার ভিন্ন পন্হার প্রস্তাব পেশ করতে চাই।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে এখন পাওয়ার টিলারের রাজত্ব। গৃহস্হদের আংগিনা এখন গবাদিশুন্য। শিশুখাদ্য দুধ এখন ব্যয়বহুল এক বিলাসী পণ্য। এর মাঝে মুসলমানরা ফি বছর লাখ কুড়ি গরু-ছাগল ছুরির নীচে ফেলেন পবিত্র কোরবানির নামে। প্রায় এক কোটি মানুষ কোরবানি দেন। সংকট সমাধানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে ’সুন্নতি’ উট। ’হিন্দু-বিদ্বেষীরা’ প্রতিবেশী ভারত থেকে  চোরাই পথে  রাতের  আঁধারে আনেন ’বিধর্মী’ গরু।   আর অধিকাংশ ক্রেতাই ঘুষ-লুটপাট-চোরা কারবারীর টাকায় ধর্মীয় ’কমিনটমেন্ট’ মেটান। পুরো প্রক্রিয়াটই এখন ধর্মীয় দায়-দায়িত্বের সীমানা পেরিয়ে সামাজিক স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে। পাল্লা দিয়ে চলে আকাশচুম্বী দামের গরু-ছাগলের জবাই। এটিকে কোরবানি ভাবতে দিলে সায় দেয় না। কোরবানির টাকাটা সৎ উপার্জনের হতে হয়।

গেল কোরবানীর ঈদে আমি পশুর বদলে লোভ-লালসা ও অন্যায়কে কোরবান দেবার আহ্বান জানিয়েছিলাম। সেই আহ্বান-অনুরোধ অরণ্যে রোদন হয়েছে। এবার আমি থাকছি হুমায়ূনের আহ্বানের সাথে। আমার পরিবারে তিন নামের কোরবানি হয়। সব মিলিয়ে গেলো বছর লেগেছিলো প্রায় তিরিশ হাজার। এবার আরেকটু বেশী লাগবে নির্ঘাৎ। আমার স্ত্রী-পুত্রের কোরবানী দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমি নিতে অক্ষম। এই অধিকারটুকু আমার নেই। তবে নিজের কোরবানির ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ অধিকার আছে। ঠিক করেছি এবছর আমি কোরবানি দেবো না। আমার কোরবানির পনেরো হাজার টাকা আমি রেখে দিলাম হুমায়ূনের প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতালের জন্যে। যতদিন বাঁচি ততোদিন আর কোরবানি না দিয়ে সেই টাকা দান করবো হুমায়ূনের স্বপ্ন দেখা ক্যান্সার হাসপাতালের জন্যে।

প্রত্যাশা করি মাত্র একলাখ মানুষ যদি চলতি বছর কোরবানির মাংস খাওয়ার লোভ কিংবা সামাজিক লজ্জ্বার ধিক্কার সামাল দিতে পারেন তাহলে অনায়াসে দেড়শ’ থেকে দুই শত কোটি টাকা যোগাড় হয়ে যায়। দিব্যি কাজ শুরু করা যেতে পারে এই টাকায়। ন্যূনতম পাঁচ বছর লাগবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে। এর মাঝে নিঃসন্দেহে যোগাড় হয়ে যাবে হাজার কোটি টাকা। হুমায়ূন আপনার ফেরার চাতকী অপেক্ষায় থাকলাম। প্রত্যাশা করি স্বপ্ন পূরণের বাদবাকী দায়িত্বটুকুও আপনি স্কন্ধে নেবেন স্বেচ্ছায়।

মহৎ একটা উদ্যোগের জন্যে যদি কোরবানি না-দেবার ধর্মীয় ’গুনাহ’র ভাগীদার হতে হয়, আমি রাজী। আপনারা ?

ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।