ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

হরেকান্দা থেকে প্যারিস

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১১
হরেকান্দা থেকে প্যারিস

কে যেন বলেছিল, “স্বাধীনতা হচ্ছে সুনির্বাচিত অধীনতা”। এতো সুন্দর করে অল্প কথায় আর কেউ স্বাধীনতাকে ব্যাখ্যা করেছেন কিনা জানা নেই।

স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে যে অধীনতাকে মেনে নিতে হয়, পরের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দিতে হয়, সেটা মূলত: শিষ্টাচারকেই নির্দেশ করে।

বাক্-স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইত্যাকার শব্দাবলি মূলতঃ এই ’স্বাধীনতা’ শব্দের সমার্থক বা অন্যরূপ। কিন্তু বাক স্বাধীনতা বা মুক্তচিন্তা আজ যে রূপে বিরাজ করছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একে ‘বর্ণবাদ’ বা ‘সাম্প্রদায়িকতার’ যুগলবন্দী বলে মনে হয়। অন্য সম্প্রদায়কে গালি দেওয়া বা যে কোনও উপায়ে অপমান করা যদি হয় মুক্তচিন্তা তবে বিশ্বশান্তির স্বার্থে এর নতুন মানবিক সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং শিষ্টাচারের ছাঁকনি দিয়ে এই শব্দগুলোকে ছেঁকে ’সুস্থ্ মুক্তচিন্তায়’ রূপান্তরের সময় এসেছে।

কিছুদিন আগে পেঙ্গুইন ম্যাগাজিনে ইসলামকে কটাক্ষ করে এক তুর্কী কার্টুনিস্টের কার্টুন প্রকাশের পরে আবারো গত বুধবার ফ্রান্সের একটা পত্রিকা একই কান্ড ঘটিয়ে মুসলমানদের চটিয়ে দিয়েছে। মজা করার অনেক অনেক বিষয় রয়েছে চারপাশে। সেটা না করে কোনও জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন সব বিষয় নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বিপরীত। ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে ঢাল হিসেবে রেখে অন্যান্য অধিকারকে কিংবা মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করা নিতান্তই গুরুতর অন্যায়।
 
মনে পড়ে ছোট বেলায় দেখেছি, গ্রামের রাস্তা দিয়ে হরেকান্দায় হিন্দুদের শোভাযাত্রা যাবার পথে মুসলমান কিছু ছেলে ছড়া কেটে ব্যঙ্গ করতে। ‘দ্যাখদি চাড়াল কদদূর গ্যালো, কদু গাছের তল দিয়ে গেল। ’ হিন্দুদের সেই অসহায় দৃষ্টি আজও মনে দাগা দেয়। শক্তির উন্মত্ততা দিয়ে কিংবা স্বাধীন মত প্রকাশের নামে যে প্রকারেই হোক কোনও গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া শুধু অনুচিত নয়; বরং সেটা অপরাধ।

বেশ কয়েক বছর আগে ডেনমার্কের একটি পত্রিকাও একই কাজ করে সমালোচিত হয়েছিল্। আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে অপরকে আঘাত করা হয় গায়ের জোরে। কিন্তু তথাকথিত সভ্য দেশগুলো সেই একই কাজ করে অনেক বেশি গোছানোভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। কিছু নিরীহ শব্দের সহায়তা নিয়ে তারা এই গর্হিত কাজগুলো করে অত্যন্ত সুনিপুনভাবে। আরেকটা পার্থক্য আছে হরেকান্দা এবং ডেনমার্ক, তুর্কী কিংবা প্যারিসের ফাজলামোর মাঝে। গায়ের জোর আছে বিধায় মুসলমান ছেলেরা ছড়া কেটে দাম্ভিকতা দেখালেও ওরা বাকী সবার দুর্নাম কুড়াতো। ভদ্রঘরের মুরব্বীরা তাদের ছেলেদের সেই সব বখাটে ছেলেদের সংগে মিশতে বারণ করতন। সেই গায়ের জোর এবং অনেকটা শব্দের স্বার্থপর প্রয়োগের মাধ্যমে পশ্চিমারা আজও বিভিন্নভাবে অন্যকে আঘাত করে চলেছে। কিন্তু পশ্চিমা এই উত্ত্যক্তকারীরা উত্ত্যক্ত করে বরং প্রশংসাই কুড়ায় বাকি সবার কাছ থেকে। অঘটন ঘটানোর পরে এদের পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায় ধাঁই ধাঁই করে। খবরের মন্তব্যে ইসলাম এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে লেখা বর্ণবাদী মন্তব্যগুলো দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, তথাকথিত সভ্য দেশে আমাদের দেশের ধর্মান্ধতার বিপরীতে উগ্র পরধর্ম-বিদ্বেষ কতো বেশী সক্রিয়।

মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ইত্যাকার ভাল ভাল শব্দের অর্থ এবং ব্যাখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক। এরা শব্দের সুবিধাজনক পক্ষপাতমূলক ব্যাখ্যা এবং অর্থ নির্ধারণ করে তার মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রের উপরে সাম্রাজ্যবাদের ছড়ি ঘুরায়। যেমন-ইসরাইলীদের নিরীহ ফিলিস্তিনি হত্যা, শব্দের মারপ্যাঁচে হয়ে উঠে ‘সন্ত্রাস দমন’। আর এই অন্যায়ের প্রতিবাদে পাথর ছুড়ে মারা হয়ে দাড়ায় ‘সন্ত্রাসবাদ’। এই কথিত সন্ত্রাস নির্মূলের নামে ফিলিস্তিনসহ সারা বিশ্বজুড়ে চলছে হত্যার মহোৎসব এবং নতুন আবিষ্কৃত অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার পালা। তালেবান, আল কায়েদার সৃষ্টি যেমন পশ্চিমাদের, তেমনি বিভিন্নভাবে উস্কে দিয়ে এই অপশক্তিগুলোকে বাঁচিয়েও রেখেছে তারা। হত্যা চালানোর মতো যুৎসই কারণ থাকা একটা বিরোধী গোষ্ঠী ছাড়া বিশ্বে আধিপত্য টিকিয়ে রাখবে কী করে! সভ্যতার ধ্বজাধারী এই শক্তিগুলো তাই বারবার অন্যের অনুভূতিতে আঘাত হেনে বিশ্বটাকে জ্বলন্ত উনোন করে রেখেছে। এই ধরনের আঘাতের সংস্কৃতি কোনওভাবেই মুক্তচিন্তার সমার্থক হতে পারে না।
 
এক সময় ডেনমার্কের সেই কার্টুনকে ঘিরে ডেনিশ পণ্য বর্জনের আবেগী ঘোষণা এসেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতেই মুসলমানেরা সেই প্রতিজ্ঞায় অটুট থাকতে পারেনি। একই চেষ্টা করেছিল ইরাক আক্রমণের পরপর মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে, ই-মেইলের মাধ্যমে কোকাকোলার মতোন সব ধরনের আমেরিকান পণ্য বর্জনের আহবান জানিয়ে। তারপর সব আগের মতোই চলেছে, এখনো চলছে।

সাধারণ মুসলমানদের ক্রোধ থেমে গেলেও ইরাক এবং আফগানিস্তানে নারী, পুরুষ, শিশু হত্যা এখনো থামেনি। বরং সেখানে যোগ হয়েছে লিবিয়ার মতো নতুন নতুন সব দেশ। অন্যদিকে, এসকল ঘটনাকে পুঁজি করে কিছু উগ্রবাদী মুসলিম সংগঠন সারা বিশ্বে তাদের হিংসা ছড়িয়ে যাচ্ছে। উগ্র উভয় পক্ষই যে যার ধ্বংসাত্বক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে। মাঝখানে শান্তিকামী মানুষের আন্দোলনটা ঝিমিয়ে গেছে। ড্যানিশ কার্টুনের পরে টিভির খবরে দেখেছিলাম, প্রতিবাদ করা কিছু ইসলামিক গ্রুপ মিছিল বের করেছিল। মিছিল শেষে বেশ উন্মত্ততার সাথে ড্যানিশ গুঁড়োদুধের বিশাল প্রতীকী কৌটায় আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল, বুশ বুঝি ঐ কৌটার ভিতর লুকিয়ে আছে। কে জানে, বিক্ষোভের পরে শরীরের শক্তিক্ষয় দূর করতে বাড়ি ফিরে কেউ ডানোর গরম দুধে চুক চুক করে চুমুক দিয়েছিল কিনা!

একটা বিষয় জরুরি হয়ে পড়েছে এখন। শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তথাকথিত বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতার উপরে একটা সীমারেখা টানা দরকার। কারো অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কোনও কাজকেই ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে বৈধতা দেয়া যাবে না। এ ধরনের আচরণের জন্য তালেবান এবং আল কায়েদার মতো সংগঠনের উপরে সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন বেড়ে যেতে পারে। এমনকি নতুন কোনও চরমপন্থী দলের আবির্ভাব ঘটতে পারে। যেমন, ইসলাইলের নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামাসের জন্ম হয়েছিল। এবং এভাবে সারা বিশ্বে ধর্মীয় কারণে সহিংসতা বাড়বে।

এ ঘটনাগুলোর  মাধ্যমে তথাকথিত সভ্য সমাজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে উৎকট বর্ণবদী রূপ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে ভণ্ডামি (হিপোক্রেসি) ধরা পড়েছে সবার কাছে। ফ্রান্স কি করবে জানি না। তবে তুরস্ক সরকার তড়িঘড়ি করে সেই কার্টুনিস্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিল। ড্যানিশ সরকার কার্টুনের জন্য ক্ষমা চাইলেও সেই কার্টুনিস্টের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।   কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছিল যে, সে দেশে মত প্রকাশের সীমাহীন অধিকার রয়েছে। কারো স্বাধীন মত প্রকাশের উপর সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাহলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী কি সেটার ব্যাখ্যা ডেনিশ সরকার তখন দেয়নি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা  এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মধ্যে কিভাবে ব্যালান্সটা করবে সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

ওদের মত প্রকাশের হিপোক্রেসিটা বেশ দারুণ। প্রায় এক দশক আগে আগে ডাচ সরকার লেবানন ও ইরান থেকে সম্প্রচারিত দুটো চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিল, তাদের ভাষায়, ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে।

শিন্ডি শিহানের করুণ পরিণতির কথা কেনা জানে! আমেরিকার অন্যায়যুদ্ধে সন্তান হারানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। আফগান যুদ্ধের সময় আমেরিকার নতুন আবিষ্কার ‘এমবেডেড জার্নালিজমের’ নামে ‘হলুদ সাংবাদিকতার’ অংশীদার না হওয়ায় বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ককে কিছুদিন আগে আমেরিকায় যেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

পশ্চিমাদের স্ববিরোধিতার এরকম হাজারো উদাহরণ মিলবে একটু খোঁজ করলেই। আল-জাজিরা টিভি বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার ইঙ্গ-মার্কিন পরিকল্পনার কথা এইতো সেদিনের। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব প্রতিক্রিয়ার ভয়ে তারা সরে আসে। মনে পড়ে, এই প্যারিসেই প্রায় এক যুগ আগে ‘দ্যা লাস্ট টেম্পটেশন অব জেসাস ক্রাইস্ট’ নামে ছবিতে যিশুকে এক মহিলার সাথে প্রেমরত অবস্থায় দেখানোর পরিণতিতে ক্রিস্টানরা প্যারিসের এক সিনেমা হল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে মারাও গিয়েছিল একজন। এভাবে এ সকল মুক্তচিন্তার হিপোক্র্যাটরা অন্যের বেলায় যাচ্ছেতাই করে পার পাবার চেষ্টা করলেও নিজেদের বেলায় ভীষণ রকম রক্ষণশীল।

অবাক করা ব্যাপার হলো, একই সাথে পশ্চিমাবিরোধী বিক্ষোভ এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে শত শত মানুষ মারা যাবার ঘটনা মুসলমানদের সত্যি সত্যি স্ববিরোধী আচরণ। ইসলাম রক্ষার নাম করে মসজিদে আত্নঘাতী বোমা মেরে মসজিদসহ মুসলমান উড়িয়ে দেওয়া কোন্ ধরনের মুসলমানিত্ব জানি না। জিহাদ মানেই ইসলামের কোথাও অস্ত্র হাতে যুদ্ধকে প্রাধান্য দেয়নি। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ হচ্ছে শেষ প্রতিবাদের ভাষা।

`জিহাদ` শব্দটি প্রথমতঃ নফসের বিরুদ্ধে যা মূলত: নিজের খারাপ গুণাগুণের বিরুদ্ধে এবং সেটা সহনশীলতা ও অপরকে শ্রদ্ধার কথা শিক্ষা দেয়। ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পশ্চিমা উস্কানিতে মুসলমানদের উগ্র আচরণ করা কোনওভাবেই ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে তাদের মর্যাদাবান করে না। লাদেন নয়, মুসলমানদের এই মুহুর্তে রোল মডেল করতে হবে মাহাথিরের মতো কোন্ও আধুনিক চিন্তার মানুষকে। এমনই একজন প্রজ্ঞাবান নেতা নির্বাচন করতে হবে যে কিনা তার জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে ইসলামের আধুনিকতা এবং মানবিক দিকটাকে সামনে নিয়ে আসবে। প্রমাণ করতে পারবে উগ্রতার স্থান ইসলামে নেই। পাশ্চাত্যের উস্কানি এবং অহংবোধের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা হোক কৌশলগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। যুদ্ধ হোক নিজেদের আত্মশুদ্ধির জন্য।
 
গণতন্ত্রের সাম্প্রতিক কৌতুক বেশ কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদ মাধ্যমে ইরাকি বন্দী নির্যাতনের নির্মম ছবি প্রকাশ পাবার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, এ ধরনের ছবি প্রকাশ করা উচিত নয়। কারণ এগুলো সহিংসতা বাড়ায় ” কি দারুণ রসিকতা! নির্যাতন করা যাবে কিন্তু তা প্রকাশ করা যাবে না। তবে কেউ কেউ কারো কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারবে। কারণ এটা তার চিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা!

mahalom72@ yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।