ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

চাঁদের কলঙ্কে অমাবস্যায় ‘বিএনপি’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৬ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২৩
চাঁদের কলঙ্কে অমাবস্যায় ‘বিএনপি’

রাজশাহী: সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনের নামে কদিন পরপরই পদযাত্রা, বিক্ষোভ ও জনসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল বিএনপি। সরকারও অনেকটা ছাড় দিচ্ছিল।

কিন্তু এক চাঁদের বেফাঁস মন্তব্য ও হুমকিতে চরম বেকায়দায় পড়েছে দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা এ দলটি। তাদের ফ্রন্টলাইনের আন্দোলন যেন এক ঝলকেই চলে গেছে ব্যাকফুটে। এক চাঁদের কলঙ্কেই অমাবস্যার আঁধারে ডুবেছে বিএনপি।

বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত দলের কোনো শীর্ষ নেতা প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। তবে গুঞ্জন চলছে সরকারপ্রধানকে হুমকি দিয়ে পুরো দলকে গর্তে ফেলেছেন চাঁদ। দেশজুড়ে দলকে পর্যুদস্ত করা বিএনপির বিতর্কিত নেতা আবু সাঈদ চাঁদকে দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। কারণ বিএনপি নেতার এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের পর কেবল রাজশাহীতেই নয়, পুরো দেশেই বিএনপিকে কঠোরভাবে রাজপথে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহোযোগী সংগঠন। আর মঙ্গলবার (২৩ মে) রাজশাহীসহ গোটা দেশে সেই কর্মসূচির ‘ট্রায়াল ভার্সন’ পর্যবেক্ষণ করেছেন সবাই। রাজশাহীতে কর্মসূচি পালনের জন্য মাঠেই নামতে পারেনি বিএনপি। আর দেশের বেশকিছু স্থানে কর্মসূচি পালন হয়েছে পাল্টাপাল্টি। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

আর এর প্রধান ইস্যুই ছিল রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি। প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও খোদ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও মনে করেন সরকারপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি নেতা চাঁদের এমন বক্তব্য দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি। কারণ তাদের আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে নয়। আর এবারই প্রথম নয়, এর আগেও আবু সাঈদ চাঁদ প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করে বক্তব্য দিয়েছেন। ওই ঘটনায় কিছুদিন আগেই জামিনে কারামুক্ত হন বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ।

তার একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলও বিব্রত। তাই এবার তিনি দলীয় পদ হারাতে পারেন বলে গুঞ্জন চলছে। সেই খবর এরই মধ্যে ডালপালা মেলেছে রাজশাহীতে। যদিও প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দিয়েই লাপাত্তা হয়েছেন চাঁদ। মঙ্গলবার পর্যন্ত রাজশাহীর পুঠিয়া, কাশিয়াডাঙ্গা ও মোহনপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিস্ফোরক ও নাশতার অভিযোগে পরপর তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহীর প্রায় সবগুলো থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদকে গ্রেপ্তারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন। যেকোনো সময় তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন।

তাই এখন সারাদেশের মানুষের কাছেই জানার আগ্রহ হয়ে উঠেছে কে এ চাঁদ?

মূলত প্রধানমন্ত্রীকে কবরস্থানে পাঠানোর হুমকি দাতা রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের উত্থান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়ন থেকে উঠে আসা এ আবু সাইদ চাঁদের অপকর্মের নানা কাহিনী এখনও রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। নব্বইয়ের দশকে নিজ এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছিলেন এ আবু সাঈদ চাঁদ।

১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তার হুকুমের বাইরে কোনো কাজই হতো না রাজশাহী ও ভারতের সীমান্তবর্তী উপজেলা চারঘাটে। হুকুম মতো কাজ না করায় সরকারি কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগও রয়েছে বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদের বিরুদ্ধে। তবে আবু সাঈদ চাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর। পরপর কয়েক দফা চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন চাঁদ। এরপর দুই দফায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। ২০০২ সালের পর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানার এক ডজনেরও বেশি মামলা চলমান রয়েছে আদালতে। নিষ্পত্তি হয়েছে আরও কুড়িটি মামলা। তাই বছরের বেশিরভাগ সময় কারাগারেই কাটে চাঁদের। কোনো সময় জামিনে কারামুক্ত হলেই আবারও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন আবু সাঈদ চাঁদ। রাজশাহী-৫ (তৎকালীণ চারঘাট-বাঘা) আসনে মনোনয়ন না দেওয়ায় রাজশাহীর জনসভা শেষে ঢাকায় ফেরার পথে বানেশ্বরে খোদ দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িও আটকে বিক্ষোভ করেছিলেন চাঁদ। ওই ঘটনার পর নিজ দলেও ছিলেন কোণঠাসা। এরপর ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে গিয়ে গাভী প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন এ চাঁদ।

তবে শেষ পর্যন্ত ধানের শীষের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ২০১৪ সালের বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। ২০১৪ সালে ওই আসনের নির্বাচিত এমপি বর্তমান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকেও হত্যার চেষ্টা করেছিলেন চাঁদ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় চারঘাট-বাঘায় ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে একাধিক মামলা আছে চাঁদের বিরুদ্ধে। ওই সময় চাঁদ বাহিনীর হামলায় চারঘাট-বাঘা এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই শতাধিক নেতাকর্মীর ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটতরাজ চলে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও মামলার তথ্য গোপন করায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।

উপজেলা পর্যায়ের এ নেতা রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হওয়ার পর আরও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠেন। বিতর্কিত, আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে শুরু করেন। তার উচ্ছৃঙ্খল বক্তব্য প্রায়ই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আবু সাঈদ চাঁদ এর আগে গত বছরও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেন। ওই ঘটনায় গত বছরের ২৬ জুলাই রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার আদালতে গিয়ে আবু সাঈদ চাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ডাকবাংলো মোড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় যখন পৌরসভার অস্থায়ী কার্যালয় ছিল, তখন ওই পৌরসভার মেয়র ছিলেন বিএনপি নেতা জাকিরুল ইসলাম বিকুল। স্থানীয় সংসদ সদস্য ছিলেন তারই দলীয় নেতা কবীর হোসেন। পৌর মেয়রের দপ্তরে বসে কথা বলার সময় সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিডি) কর্মকর্তা। কিন্তু সংসদ সদস্যের সঙ্গে দেখা করার আগেই ওই কর্মকর্তাকে রাস্তার ওপর ফেলে বেধড়ক পেটান বিএনপি নেতা আবু সাইদ চাঁদ। চাঁদের অভিযোগ ছিল তার কথা মতো চাল ও গম বরাদ্দ দেননি ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। বিএনপি শাসনামলে চাঁদের মুখের কথাই আইন ছিল চারঘাট উপজেলার মানুষের জন্য। তার সর্বশেষ কাণ্ড ছিল সরকারপ্রধানকে হুমকি!

গত শুক্রবার (১৯ মে) রাজশাহীর পুঠিয়ার শিবপুরে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। সমাবেশের শেষে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কবরস্থানে’ পাঠানোর হুমকি দেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদ।
ওইদিন নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আর ২৭ দফা ১০ দফার মধ্যে আমরা নেই। এক দফা- শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠাতে হবে, শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠাতে হবে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য যা যা করার দরকার, আমরা করব ইনশাআল্লাহ’।

তার এ বক্তব্যের ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে রাজশাহীসহ গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। চাঁদকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গণধোলাইয়ের ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরা। রাজশাহীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার কুশপুতুল দাহ করা হয়।

আর এখন থেকে বিএনপিকে রাজপথেই প্রতিরোধ ও মোকাবিলার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। সোমবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া গত দুদিনে রাজশাহীর তিন থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন। যদিও হুমকি দিয়েই লাপাত্তা হয়েছেন বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ।

চাঁদের এমন কাণ্ডে এখনও তার দলের শীর্ষ নেতার প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিনু।

তিনি বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো বিদ্বেষ নেই। বিএনপি দীর্ঘসময় থেকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে। কারণ আমরা জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। দেশের সব রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের মানুষ মনে করেন গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। আর গণমানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্যই আমরা রাজপথে রয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা আবু সাইদ চাঁদের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। তার ওই বক্তব্য বিএনপির দলীয় বক্তব্য নয়। আবু সাঈদ চাঁদের ওই বিতর্কিত বক্তব্য একান্তই তার নিজস্ব। এর দায় দল নেবে না’।

মিনু বলেন, ‘রাজশাহীতে বিএনপির সিনিয়র নেতা হিসেবে আবু সাইদ চাঁদ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দিয়েছেন- সে কারণে আমি দুঃখপ্রকাশ করছি। সরি বলছি’।

প্রসঙ্গত, রাজশাহীতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের জোরালো আপত্তির পরও বিগত ২০১৯ সালের ৫ জুলাই বিতর্কিত নেতা আবু সাঈদ চাঁদকে আহ্বায়ক করে ৪১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা কমিটি করে দেয় দলীয় হাইকমান্ড। আর জেলার কমিটি ঘোষণার পর থেকেই তা বাতিলের দাবি জানান তৃণমূল নেতাকর্মীরা। শুরুতে নানা কর্মসূচিও পালন করেন। কিন্তু ওই আহ্বায়ক কমিটি বাতিল হয়নি; চার বছরে হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটিও। হালে নতুন উস্কানিমূলক বক্তব্যের পর তাই ওই পক্ষ আবারও ভেতরে ভেতরে জেলা বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবি তুলেছেন। তাই সর্বশেষ কাণ্ডে বিএনপি নেতা চাঁদ এবার পদ হারাতে পারেন বলে গুঞ্জন চলছে। আর তার বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিয়ে আবারও আন্দোলনে ফিরতে চাইছে বিএনপি।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৪ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২৩
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।