ঢাকা: বাংলাদেশের স্থপতিসহ রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘বেফাঁস’ কথা বলে অন্তত ১২টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা বিচারাধীন রয়েছে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে ‘কটূক্তি’ করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় পড়েছেন দলীয় চেয়ারপারসন ও তারেকের মা খালেদা জিয়া।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মামলা হয়েছে গত দু’বছরে। এ সময়ে তিনি লন্ডন থেকে বসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন প্রকার মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন। ওই সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকবন্ধু’, ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ ‘রাজাকার’- এ ধরনের মন্তব্যসহ বিভিন্ন কটূক্তি করেন। এসব বক্তব্যের পর সারা দেশে তার বিরুদ্ধে মানহানিসহ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। আর তার বক্তব্য প্রচার করায় ইটিভির সাবেক চেয়ারম্যান এম এ সালামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়।
এমনকি তারেকের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন উচ্চ আদালত।
দণ্ডবিধির ১২৪ (ক) অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১২৩ (ক) অনুসারে রাষ্ট্রসৃষ্টির নিন্দাকরণ ও উহার সার্বভৌমত্বের বিলোপ সমর্থন করার অভিযোগে সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার সাজার বিধান রয়েছে।
তথ্য মতে, নব্বইয়ের দশকে গণআদালতের বিচার পরিচালনা করায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। এ মামলায় হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। তবে জীবিত অবস্থায় এ মামলা প্রত্যাহার না করা হলেও জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শহীদ জননীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের সেই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
২০০৩ সালের ২৯ নভেম্বর ব্লিৎস পত্রিকার সম্পাদক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী ইসরায়েলে যাওয়ার উদ্দেশে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। এ সময় তার কাছ থেকে ‘এডুকেশন টুয়ার্ডস কালচার অব পিস’ শীর্ষক কনফারেন্সে উপস্থাপনের জন্য একটি ভাষণের কপি ও সিডি উদ্ধার করা হয়। ২০০৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েলে এ কনফারেন্স হওয়ার কথা ছিল।
এ ঘটনায় পরে ২০০৪ সালের ২৪ জানুয়ারি বিমানবন্দর থানায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে পুলিশ।
২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ জহুরুল হক ওই মামলায় সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। এ মামলা বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১৪ জুলাই ‘সংবিধান ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে’ বলে মন্তব্য করেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনী। এজন্য তার বিরুদ্ধে লালবাগ থানার ওসি ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেন। অবশ্য এর মধ্যে তিনি মারা গেছেন।
এছাড়া তারেক রহমান, সাদেক হোসেন খোকা ও মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত কয়েক বছরে অনেকগুলো মামলা করা হয়। বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনে বিভিন্ন সভায় তারেক রহমান রহমান বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দেন।
এ বক্তব্য প্রচারের পর তারেক রহমান ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল ইটিভির মালিক আবদুস সালামের বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে পুলিশ। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তারেক রহমান তার বক্তব্যে দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন মন্তব্য করেছেন, যাতে জনমনে হিংসার উদ্বেগ হয়েছে।
এছাড়া ফেরারি আসামি হিসেবে তারেক রহমানের বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করে ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। এজন্য তারেক রহমান ও আবদুস সালামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়।
তারকে রহমানের এসব বক্তব্যের পর রংপুর, শেরপুর, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, মাগুরা, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে আইন অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সরকারের অনুমোদনের নিয়ম রয়েছে। সে কারণে অনেক মামলায় এখনো অনুমোদন না পাওয়ায় সেগুলো রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় পরিণত হয়নি।
যে কয়েকটিতে অনুমোদন পাওয়া গেছে সেগুলোতে আদালতে প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে। এ রকম একটি হচ্ছে ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সভাপতি মশিউর মালেকের করা মামলা। দণ্ডবিধি ১২৩ এর (ক) ধারায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণের অভিযোগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে করা হয় মামলাটি। এ মামলায় ইতোমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল অঞ্চলের সহকারী পুলিশ কমিশনার জুয়েল রানা ঢাকার মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূরের কাছে তারেকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
২০১৪ সালের বছরের ১৪ অক্টোবর রাজধানীর ভাসানী মিলনায়তনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর উদ্দেশে আয়োজিত এক সভায় বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা নেতাকর্মীদের দা, কুড়াল, খুন্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
তার ওই বক্তব্যের পর রাজধানীর পল্টন থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়। পরে তদন্ত করে ওই বছরের ০৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন এসআই খায়রুল মো. শহীদুল্লাহ প্রধান। গত বছরের ০৮ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার পুলিশ পরিদর্শক তোফায়েল আহমেদ ঢাকার সিএমএম আদালতে মামালাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০১৫ সালের শুরুতে টেলিকথোপকথনে সেনা বিদ্রোহে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়।
২০১৫ সালের ৪ মার্চ স্বাক্ষর করা অনুমতিপত্র পুলিশ পাওয়ার পরপরই এ মামলা দায়ের হয়।
এ সব মামলা চলমান থাকা অবস্থায় গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। আজকে বলা হয়, এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া দাবি করেন, ‘তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না’।
পরে এ বক্তব্যে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে বিচারিক আদালতে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোমতাজ উদ্দিন আহমদ মেহেদী।
মামলার পর বিচারিক আদালত খালেদার বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন। আগামী ৩ মার্চ তাকে হাজির হওয়ার জন্য এ সমন জারি করেছেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদ তালুকদারের আদালত।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
ইএস/এসএইচ/এএসআর