ঢাকা: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদ ছাড়তে চান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মন্ত্রিসভায় থাকা জাতীয় পার্টির সদস্যরা একযোগে পদত্যাগে রাজি না হলে নিজেই প্রথমে পদত্যাগ করতে চান।
জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতারা এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জাতীয় পার্টির নবনিযুক্ত কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘তিনি (এরশাদ) পদত্যাগ করার জন্য রেডি আছেন। কিন্তু আমরাই পরামর্শ দিয়েছি একসঙ্গে পদত্যাগ করতে পারলে ভালো হতো। তাই কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে’।
‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাভাবিকতায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। জনগণের মধ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। আমাদের দলের মধ্যেও কিছু সংকট রয়েছে। তবে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসতে চাই’ বলেও মন্তব্য করেছেন এরশাদ মনোনীত তার এই উত্তরসূরি।
বিশেষ দূত পদ থেকে পদত্যাগের এ সিদ্ধান্তের পেছনে এরশাদের কিছুটা জিদও কাজ করছে বলে জানা গেছে। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে দলের মধ্যে। বিশেষ করে মন্ত্রিসভায় থাকা সদস্যরা কোনোভাবেই সায় দিচ্ছেন না এরশাদের কথায়।
মন্ত্রিসভায় থাকা এক সদস্য সম্প্রতি মিডিয়ার সামনে বলেছেন, ‘আমাদের পদত্যাগ করতে বলেন কেন? নিজে আগে পদত্যাগ করে উদাহরণ সৃষ্টি করলেই পারেন। তিনিতো সেটা করছেন না’।
নিজ দলের সিনিয়র নেতাদের এমন বক্তব্যে খুবই বিব্রত এরশাদ। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে নিজেই প্রথম পদত্যাগ করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চান বলে ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন। তবে ঠিক কখন পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন সে বিষয়ে জানা যায়নি।
মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের বিষয়ে তৃণমূল নেতাদের চাপও রয়েছে এরশাদের ওপর। প্রত্যেকটি সভা-সমাবেশে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সরকার থেকে বের হয়ে প্রকৃত অর্থে বিরোধী দল হওয়ার জন্য মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। গত সোমবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় পার্টির যৌথসভায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও জাতীয় পার্টিকে সত্যিকারের বিরোধী দল হওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন।
আর সত্যিকারের বিরোধী দল হতে হলে দলের মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগ করার জন্য পরামর্শ দেন তৃণমূলের নেতারা।
যৌথসভায় মাগুরা জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. হাসান সিরাজ সুজা বলেন, যদি জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভায় না থেকে সত্যিকারের বিরোধী দল হয়, তাহলে বিএনপির অস্তিত্ব থাকবে না। তাদের পদত্যাগে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যত অনেক ভালো হবে। এজন্য পার্টির চেয়ারম্যানকেও বিশেষ দূতের পদ থেকে রিজাইন দিতে হবে।
হাসান সিরাজ সুজার মতো আরও অনেক জেলার নেতারা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পক্ষে মতামত দেন।
অনেকদিন ধরেই এরশাদও সতিক্যারের বিরোধী দল হওয়ার জন্য মন্ত্রিসভা ছাড়ার কথা বলে আসছিলেন।
জিএম কাদেরতো প্রথম থেকেই মন্ত্রিসভায় থাকার বিপক্ষে। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘এইটা দ্বিচারিতা। আপনি একই সঙ্গে একটি দলের গোলকিপার আর অপর দলের স্ট্রাইকার হতে পারবেন না। জাতীয় পার্টি ঠিক সেটাই করছে। একদিকে বলছে, বিরোধী দল, আবার অন্যদিকে সরকারের অংশীদার হিসেবে রয়েছে’।
বছরখানেক আগে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভায় থাকা তিন সদস্যের আপত্তির কারণে বিষয়টি ঝুলে গেছে।
এদিকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ প্রশ্নে এরশাদের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তার সুপারিশে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হলেও পরে আর কেউই তার কথা শোনেননি। যখনই পদত্যাগ করতে বলেছেন সঙ্গে সঙ্গে এরশাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা। একবারতো দলই ভেঙে গেছে। সাধের লাঙল প্রতীক রক্ষা করতে আদালতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে পতিত এই শাসককে।
সেসব কারণে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ নিয়ে মহা টেনশনেও রয়েছেন এরশাদ।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের জন্য জেল থেকে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ঐকমত্যের সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। তৎকালীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শপথ নেন যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে।
দেড় বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের মামলা প্রত্যাহারজনিত কারণে মতপার্থক্য দেখা দেয় জাতীয় পার্টির। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন এরশাদ।
কিন্তু আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পদত্যাগ না করে পাল্টা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান দাবি করেন। তখন জাপার সংসদ সদস্যরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। অল্পের জন্য সংসদীয় দলের নেতার পদ রক্ষা করতে পারেন এরশাদ। শেষে মঞ্জু লাঙল নিয়ে টান দিলে আদালতেও গড়ায় বিষয়টি।
এরপর ২০০৮ সালে মহাজোট সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। তখন জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রিসভায় মনোনয়ন পান প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের। জনশ্রুতি রয়েছে, জাপার আরও দু’জনকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আগ্রহ দেখালেও এরশাদের অনিচ্ছার কারণে মাঝপথে থেমে যায় সে উদ্যোগ।
সেবারও মহাজোট থেকে বের হয়ে আসার জন্য আপন ছোট ভাই জিএম কাদেরকে এরশাদ পদত্যাগ করতে বললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
অন্যদিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সরকারে শপথ নেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ (স্বাস্থ্যমন্ত্রী), পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার (বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী), ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (পানিসম্পদমন্ত্রী), মুজিবুল হক চুন্নু (যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী) অ্যাড. সালমা ইসলাম (মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী)। এছাড়া মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।
এরপর সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কথিত রয়েছে, একটি বিশেষ দলের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সরে দাঁড়ান তিনি। আর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েই দলের নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসার নির্দেশ দেন এরশাদ।
এবার শুরু হয় নাটক। ‘এই এখন পদত্যাগ জমা দেবো, তখন পদত্যাগ করছি’- এভাবে কেটে যায় তিনদিন। পরে মিডিয়ার সামনে বলা হয়, তারা পদত্যাগপত্র দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সরকার গ্রহণ করে নাই। সে কারণে তারা ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুসহ বেশ কয়েকজন পদত্যাগই করেননি বলেও জানিয়েছিলেন তখন।
এসব কারণে পদত্যাগ নিয়ে চলতে থাকে ধুম্রজাল। জিএম কাদের ছাড়া অন্য সকলেই জাতীয় পতাকাবাহী গাড়ি নিয়েই চলাচল করতে থাকেন। পুরোটা সময়েই তাদের বাসায় জাতীয় পতাকাও উড়তে দেখা গেছে।
নির্বাচনী সরকারের শেষদিন পর্যন্ত সকল সুযোগ-সুবিধা নেনও জাতীয় পার্টির নেতারা। অনেক নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। তখন কেউ কেউ জাতীয় পার্টিকে ব্যঙ্গ করে ‘যাত্রাপার্টি’ বলেও অভিহিত করেন।
নির্বাচন শেষে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তাতে রওশন এরশাদের দেওয়া তালিকা থেকে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (পানিসম্পদমন্ত্রী), মুজিবুল হক চুন্নু (শ্রম প্রতিমন্ত্রী) ও মসিউর রহমান রাঙ্গার (স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী) ঠাঁই হয় মন্ত্রিসভায়।
গঠনের পর থেকেই গত প্রায় তিন দশক ধরে এরশাদের একক সিদ্ধান্ত চলেছে জাতীয় পার্টি। এখন রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সক্রিয়। তারা পুরোপুরি রওশনের নির্দেশনায় চলছেন। আগে এরশাদের সুপারিশে মন্ত্রী হয়েও তার কথা কানে নেননি, এবার রওশন এরশাদের সুপারিশে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাওয়ারা এরশাদের কথা কেনো শুনবেন?- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে স্বয়ং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যা বলেছেন তাতেও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন অনেকে। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছেন, ‘শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর দূত থেকে পদত্যাগ করবো’। এর কয়েকদিনের মাথায় বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সম্মান করে আমাক এ পদে মনোনীত করেছেন। পদত্যাগ করে তাকে অসম্মান করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করবো, আমাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য’।
** হঠাৎ নমনীয় এরশাদ
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এসআই/এএসআর