কুষ্টিয়া: মাঠের মাঝখান দিয়ে সরু পিচঢালা রাস্তা। মাঠ পেরিয়ে গ্রাম।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষের আনাগোনা। দুপুর কিংবা বিকেলে গ্রামের বাতাসে মিষ্টি তালের রসের সুগন্ধ পাওয়া যায়। একটি গ্রামের মাঠে আর রাস্তায় ১৫-২০ হাজারের বেশি তালগাছ রয়েছে। গ্রামটি যেন তালগাছেরই। গ্রামের দাউদ বিশাঁস নামে এক ব্যক্তি তার জমির সীমানা এবং শ্রমিকদের ছায়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করেন তালগাছ রোপণ। সেই গাছের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন পুরো গ্রামের চারপাশ ছেয়ে গেছে। আর এ তালগাছকে কেন্দ্র করে এখন অনেকটাই সচ্ছল গ্রামের কৃষকরা। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের ০৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাকিলাদহ গ্রামের চিত্র এটি।
সদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে, ৪ হাজার ৪৩৬ জন ভোটারের বসবাস এ গ্রামে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৪৪ জন পুরুষ এবং ২ হাজার ৯২ জন নারী ভোটার।
নানা পেশাজীবী মানুষের মধ্যে গ্রামটিতে শুধুমাত্র তালগাছকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে দেড় শতাধিক পরিবার। যাদের আর্থ ও সামাজিক উন্নতি হচ্ছে এ তালগাছ থেকে। এক মৌসুমে শুধুমাত্র তালের রস বিক্রি করেই এ গ্রামের মানুষের আয় হয় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার বেশি। অনেকে পেশা পরিবর্তন করেন তালের রসের মৌসুমে।
তালের রস, তালের শাঁস, পাকা তাল, তালের পাতা ইত্যাদি বিক্রি করেন তারা। এর মধ্যে বেশি লাভজনক হলো তালের রস। তারা দুই ধরনের তালের রস সাধারণত বিক্রি করেন। কাঁচা মিষ্টি রস এবং জাল দেওয়া পাকা রস। তবে কাঁচা রসের চাহিদায় বেশি।
তালের গাছিদের দেওয়া তথ্য মতে, শুধুমাত্র কাকিলাদহ গ্রামে এ তালের রস বিক্রির সঙ্গে জড়িত ১০০-১৫০টি পরিবার। যারা দীর্ঘ ২০-২৫ বছর ধরে এ পেশায় রয়েছেন। গরমের সময় এ সংখ্যা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। এক এক গাছ থেকে চার মাসে একজন ২০ হাজার টাকার বেশি আয় করেন।
তালের রস বিক্রির করতে তাদের হাট বাজারে যেতে হয় না। কারণ গাছের নিচেই ক্রেতারা এসে ভিড় করেন। সকাল এবং বিকেল দুই বেলা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন গাছিরা। দিনে গাছ ভেদে ৭০০-১৫০০ টাকার রস বিক্রি হয়।
কাকিলাদহ গ্রামের মহসীন আলী। পেশায় একজন কৃষক। কৃষি কাজের পাশাপাশি চৈত্র-জ্যৈষ্ঠ মাস জুড়েই তালগাছ কেটে রস সংগ্রহ করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে।
মহসীন আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর ধরে তালের রস বিক্রি করি। প্রতি বছর চৈত্র মাস থেকে তালগাছ কেটে রস সংগ্রহ শুরু হয়। সেটি চার মাস চলে। জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে রস কমে আসে, তখন কৃষি কাজ করি। বর্তমানে আমি দুটি তালগাছ বর্গা নিয়ে রস বিক্রি করছি। এক মৌসুমে গাছের মালিককে দুই গাছ বাবদ এক হাজার টাকা দিতে হয়। সব দিন রস সমান হয় না। তবে দিনে দুই বেলা রস নামানো হয় গাছ থেকে। সকালে পাঁচ ভাঁড় (মাটির ছোট হাঁড়ি) হয়, আর বিকেলে তিন ভাঁড় হয়। এক ভাঁড় রস বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। এতে দিনে ৭০০-৮০০ টাকার মতো রস বিক্রি হয়। মাঝে মধ্যে রস বেশিও পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, এক সময় আমার নিজের ৪৫টি তালগাছ ছিল। পরে জমি ভাগাভাগি এবং গাছ কেটে ফেলায় আর নেই। এখন অন্যের গাছ বর্গা (টাকা দিয়ে ভাড়া নেওয়া) নিয়ে রস সংগ্রহ করি। দুই গাছ থেকে চার মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকার মতো রস বিক্রি করা যায়। তবে এখন গড়ে প্রতি গাছে ২০ হাজার টাকার মতো রস অনায়াসে হয়। অন্য কাজের চেয়ে এতে আয় বেশি।
সকাল এবং বিকেলে কাকিলাদহ এলাকায় গেলেই দেখা যায়, গাছি কোনো গাছ কাটছেন, কেউ গাছে ভাঁড় বসাচ্ছেন, আবার কেউ রস ভর্তি ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে আনছেন। আর গাছের নিচে ক্রেতারা ভিড় করছেন, আবার রাস্তার ধারে যেখানে-সেখানে রস বিক্রি করছেন অনেকে।
গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রাজ্জাক তালগাছে বাঁধা মাটির হাঁড়ি থেকে রস সংগ্রহ করছেন। একটা গাছে তিনি আট-১০টা হাঁড়ি বেঁধেছেন। সেখান থেকে জমা হওয়া রস অন্য পাত্রে ঢেলে নিয়ে আসছেন।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি কৃষিকাজের পাশাপাশি ৩০-৩৫ বছর ধরে তালগাছ কাটি, তালের রস বিক্রি করি। গাছ কাটার সময় গাছের সঙ্গে বাঁশ বেঁধে দিই, যাতে উঠতে সুবিধা হয়। তালের রস খুবই সুস্বাদু, মিষ্টি। অনেক এলাকা থেকে লোকজন আসেন এখানে রস খেতে। গ্রামের অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তালগাছ থেকে।
সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের গ্রাম এখন তালগাছের জন্য বিখ্যাত। তাল গাছ থেকে রস পেড়ে বিক্রি করে অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন। সেই সঙ্গে তালগাছ বেশি থাকায় বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।
তালের শাঁস বিক্রেতা সানজিদ আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, তালগাছ থেকে তাল পেড়ে আমরা তালের আঁটি (শাঁস) হিসাবে বিক্রি করি। একটি তালে সাধারণত তিনটি আঁটি থাকে, যার একেকটির দাম পাঁচ টাকা। শক্ত আঁটির চেয়ে নরম আঁটির চাহিদা বেশি। দিনে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকার মতো তালের আঁটি বিক্রি করি।
সোহেল রানা নামে একজন বাংলানিউজকে জানান, কাকিলাদহ এলাকায় এলে আসল তালের রস পাওয়া যায়। চোখের সামনেই গাছিরা গাছ থেকে রস নিয়ে এসে বিক্রি করেন। তাই এখানে মাঝে মধ্যে তালের রস খেতে আসি।
মোটরসাইকেলে করে চুয়াডাঙ্গা থেকে কুষ্টিয়া যাচ্ছিলেন তারিক ও সুমন। পথে কাকিলাদহ গ্রামের রাস্তায় যাত্রাবিরতি দিয়েছেন তারা। তারা বলেন, কুষ্টিয়ায় যাচ্ছিলাম, কাকিলাদহে রাস্তার পাশে দেখছি তালগাছের নিচে রস বিক্রি হচ্ছে। প্রতি গ্লাস ১০ টাকা করে। তাই খেলাম, খেতে ভালো লাগল।
সদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কাকিলাদহে তালগাছের সংখ্যা অনেক। সেখানকার লোকজন তালের রস বিক্রি করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই এ পেশা থেকেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তালগাছ খুবই উপকারী, সেই সঙ্গে সেখান থেকে আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছেন অনেকে।
মিরপুর উপজেলর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাইম হোসেন জানান, কাকিলাদহ এলাকায় তালগাছের কারণে কৃষকদের বাড়তি আয় হয়। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা তালগাছ কেটে রস সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। একশ থেকে দেড়শ পরিবার তালের রস বিক্রি করে চার মাসে গড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে আয় করে।
এদিকে জেলাজুড়ে তালগাছ রোপণের জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ।
তিনি জানান, তালগাছ বজ্রপাতসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢাল হিসেবে কাজ করে। রাস্তার ধারে পতিত জমিতে তালের চারা বা আঁটি রোপণের জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সেই সঙ্গে কৃষকরা এ তালের রস বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০২৩
এসআই