এই সাদামাটা কথায় সেরে ফেলা যেত ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’র আলোচনা। কিন্তু তরুণ এই লেখকের সঙ্গে বইমেলা চত্বরে কয়েক মিনিটের আলাপে মনে হলো উপরের দায়সারা গোছের বর্ণনায় বাঁধা যাবে না ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ বইটিকে।
লেখকদের একটা দায়বদ্ধতা থাকে! কী সেই দায়বদ্ধতা? সেই দায়বদ্ধতার ব্যাপ্তি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত? সে কি কেবল মানুষের প্রতি? শুধু কি জীবের প্রতি? শুধু কি নর-নারীর প্রতি? নাকি তার চারপাশে যা কিছু আছে- সব কিছুর প্রতি?
প্রথমে ধরে নেওয়া যাক, লেখকের দায়বদ্ধতা নিজের প্রতি! সবার আগে নিজেকে আবিষ্কার করেন তিনি। নিজেকে জানার চেষ্টা করেন। একটু একটু করে নিজেকে চেনেন। আর এই চেনা-জানার ভেতর দিয়ে নিজস্ব সম্পর্কের অর্গ্যানগুলো তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন, কার সঙ্গে তার সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়, সবচেয়ে পুরাতন, সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে আপেক্ষিক, অনিবার্য ও সত্য! এক পর্যায় লেখক এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন প্রকৃতির সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, সেটিই মানুষের চিরকালীন সম্পর্ক। ‘মানুষের সঙ্গে এ সম্পর্ক রক্তমূলের সমতুল্য’।
‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ ঢোকার আগে লেখকের মুখ থেকে শুনতে চাওয়া, ‘কী আছে ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’-এ? সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের জবাবটা এ রকম- ‘আমার প্রথম গল্পগ্রন্থে কোনো থিম ছিলো না। ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ গল্পগ্রন্থে একটি থিম আছে; তা হলো- প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক স্বীকার বা অস্বীকারে কোন কোন ঘটনা ঘটতে পারে, তাই গল্পের মূল কথা। আরও কিছু লৌকিক আচার বিশ্বাস যেমন, গাস্বী, হালখাতা, গনেশ পূজা বা খোইজ খিজিরের শিন্নি মানত বিষয়গুলো এসেছে বর্ণনায়।
লেখকের স্বীকারোক্তি যদি মেনে নিই, ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’-এ একটি থিম আছে; সেটি হলো-প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। অর্থাৎ, এ শ্রেণীর গল্পে প্রকৃতির পটভূমিতে চরিত্রাঙ্কন করতে হবে। মানুষের সুখ-দুঃখের পশ্চাৎপট রূপে ব্যবহৃত হবে প্রকৃতি।
তাহলে তো ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া ‘জলের দাগ’, ‘প্রাণের বন্ধক’, ‘গন্তব্য’, ‘জল মাটির আঘাত’, ‘গল্পটা দুজনের’, ‘অবিশ্বাস পিনিস’, ‘নিম সত্য’, ‘ভাঙন’, ‘নাগরিক ছাদের ঘর’ ‘কার্তিকের দিনে’ ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’, ‘গোর’ ১২টি গল্পে বর্ণিত চরিত্র, ঘটনা, পরিবেশ, প্রতিবেশ অনুষঙ্গের মধ্যে খুঁজতে হবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক।
হ্যাঁ- রক্তমূলে বিচ্ছেদ’র প্রায় সবগুলো গল্পেই একটু একটু করে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের বয়ান। কয়েকটি গল্পে রয়েছে নগরজীবনে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বিস্তার-সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গ।
‘জলের দাগ’ গল্পে- ‘সেদিন আশ্বিনের রাতে আজইগাঁতির অনেকেই জেগে। ভোর হলেই একদল ঢোল-ডগর নিয়ে মাঠে বেরিয়ে যাবে। কাঁচা হলুদের সঙ্গে শুন্ধি বেটে মাখবে আফলা ধানগাছের গায়ে। অনুর্বর জমির জরায়ু থেকে শস্যপ্রাপ্তির আশায়। সন্ধ্যা থেকে গাস্বীর গান বাঁধছে কৃষকেরা। ’ এ বর্ণনায় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক ও লোকাচার-নস্টালজিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ’
যে সময়টিতে বসে সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম ‘জলের দাগ’ লিখছেন সে সময়ে কেউ অনুর্বর জমির জরায়ু থেকে শস্যপ্রাপ্তির আশায় শুন্ধি বেটে আফলা ধানগাছে মাখে না। বরং অধিক ফলনের আশায় উন্নত প্রজাতির চারা রোপণ করে; হাইব্রিড বীজ পবন করে; রাসায়নিক সার ব্যবহার করে! জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধনের ফলে মানুষের মগজ থেকে ‘শুন্ধি বেটে আফলা ধানগাছে মাখার চিন্তা অনেক আগেই দূর হয়েছে। বিশ্বাস এখন তার বিজ্ঞানে। লোকাচারে নয়!
তাহলে লেখক এটা কোথায় পেলেন? লেখক পেলেন তার সত্ত্বায়, অতীত অভিজ্ঞতায়, হৃদয়ে ধারণ ও লালন করা বিশ্বাসে। যেখানে লেখকের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল প্রোথিত!
সরাসরি আলাপে এ ব্যাপারে লেখকের বক্তব্য হলো, আমি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটাকে ধরতে চেয়েছি। যা ছিলো, হারিয়ে গেছে। হারানো সেই লোকাচার, জল, মাটি, বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের পারস্পারিক চিরকালীন সম্পর্কই গল্পের মূল বিষয়। এখানে সময়টা বড় কথা নয়, বস্তু ও ঘটনাটাই বড় কথা। তাছাড়া গল্পের ছোট্ট প্লটে পুরো ‘সময়’-কে ধারণ করা সম্ভব নয়। উপন্যাসে হয়তো বা সম্ভব।
গ্রন্থের শিরোনাম গল্প ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ মূলত ফেলে আসা অতীত, স্মৃতিকাতরতা, আপত্যবোধ ও বাৎসল্যরসে সিক্ত। মফস্বলে বেড়ে ওঠা দরিদ্র স্কুল শিক্ষকের মেয়ে নগরজীবনে এসে পহেলা বৈশাখ পালন করছে দুই ‘পেগ’ খেয়ে। এই পহেলা বৈশাখেই বাবার সঙ্গে গগণকাকুর দোকানে হালখাতায় খাওয়া ঠাণ্ডা দই, সাদা চৌকো ছানা, দুই ফালি তরমুজ এখন তাকে আর টানে না। বন্ধুদের ফোনে আরও দুই পেগ খাওয়ার ‘বৈশাখী’ আমন্ত্রণ!
এরই মধ্যে লেখকের সামনে এসে দাঁড়ায় ‘মা’! যে কিনা তার জন্য এই ইট, কাঠ, কংক্রিটের নগরজীবনে লেখকের শৈশবের আসল ‘বৈশাখ’ টেবিলে সাজিয়ে বসে আছেন। এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা। এতোক্ষণ টেনে এনে গল্পটাকে এক ধাক্কায় পাঠিয়ে দিলেন পরিণতির দিকে।
….ঢাকনাটা তুলে আমার গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠল। সত্যি রান্না হয়নি। টকটকে লাল রঙের তরমুজ কেটে রাখা। আরেকটা তুললাম- দই, চিড়ে ভেজানো, কাঁসার প্লেটে ছানা সাজিয়ে রেখেছে; কাচের বয়ামে মিছরির খণ্ড। তিনটি প্লেট সাজিয়ে রেখেছেন মা, কিন্তু মানুষ তো আমরা দুজন।
গল্প বলা সহজ কথা নয়; বেশ কঠিন। সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম সেই কঠিন কাজ কতটা সুচারুরূপে করতে পেরেছেন- সে বিচারের ভার আপাতত পাঠকের উপর থাক। এই মুহূর্তে যা বলা যায় ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ গল্পগ্রন্থে সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম প্রমাণ করলেন তিনি চলেছেন এক দূরের যাত্রায়।
‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’ বইটি প্রকাশ করেছে ‘অন্য প্রকাশ’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। বইটির গায়ের মূল্য ২২৫ টাকা। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অন্য প্রকাশের প্যাভিলিয়নে ২৫ শতাংশ ছাড়ে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৭
এজেড/এএ