এই সেই জুয়েল যিনি ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে আজম ট্রফিতে পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। ব্যাট হাতে মাঠে নামতেন ওপেনিং অর্ডারে।
কিন্তু সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান দলের হয়ে তার খেলা হয়নি। হবেই বা কী করে তিনি যে পূর্ব পাকিস্তানি। সেই অপ্রাপ্তি থেকেই হয়তো দেশ মাতৃকাকে পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচাতে ব্যাট ছেড়ে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত জুয়েলের সেই অপ্রাপ্তি আর পূর্ণতা পায়নি। কেননা ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্টে গভীর রাতে পাক সেনাবাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন তেজগাঁওয়ে এমপি হোস্টেলের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখান থকে আর ফেরা হয়নি এই মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটারের।
ধারণা করা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কথিত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার আগে ৪ সেপ্টেম্বের মধ্যে কোনো এক সময়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার সাথে আরও ছিলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ, আজাদ, বদি, রুমিসহ আরও বেশ কয়েকজন।
ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন জুয়েল। সেই প্লাটুনের সদস্য হিসেবে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়েছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস করতে। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হাতের আঙুলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সেখান থেকেই আহত জুয়েলকে আটক করে পাকিস্তানিরা।
কোনো এক স্বাজাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ২৯ আগস্ট গভীর রাতে মগবাজারের রেলক্রসিং সংলগ্ন আজাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ক্র্যাক প্লাটুনের তথ্য ও সবার পরিচয় জানার জন্য তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। যে হাত দিয়ে তিনি ব্যাট ধরতেন, সে হাতের দুটি আঙুল কেটে ফেলা হয়। এমন নির্যাতনের পরেও একটা তথ্যও তার মুখ থেকে বের করে নিতে পারেনি পাক হানাদারের দল।
জুয়েল যখন এইচএসসিতে পড়েন তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তিনি যখন ঢাকা আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলেন তখন রকিবুল হাসার সেখানে অনুশীলন করতেন। এক পর্যায়ে দুজনই পূর্ভ পাকিস্তানের হয়ে খেলেছেন। একই কক্ষে কেটেছে তাদের স্বর্ণালি সময়।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেন না, টাইগারদের সাবেক এই অধিনায়ক, ‘ক্রিকেটের সুবাদেই তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি আজাদ বয়েজে খেলতেন আমিও তখন আজাদ বয়েজে অনুশীলন করতাম। পরবর্তীতে জুয়েল আজাদ বয়েজ থেকে চলে যায় মোহামেডানে। আমি আজাদ বয়েজে থেকে যাই। একটা সময় আমার খেলার ধারাবাহিকতায় আমি এগুতে থাকি এবং যখন ক্লাস নাইন কী টেনে পড়ি তখন পূর্ব পাকিস্তান একাদশ দলে সুযোগ পেয়ে যাই। সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কায়েদে আজম ট্রফিসহ আরও অনেক টুর্নামেন্ট খেলা হতো। এই কায়েদে আজম ট্রফিতে প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্যতা জুয়েলের ছিল এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। ’
জুয়েলের মধ্যে বাঙালিত্ব দারুণভাবে কাজ করতো উল্লেখ করে রকিবুল আরও বলেন, ‘তার ভেতরে সবচাইতে বড় যে বিষয়টি ছিল সেটি হলো বাঙালিত্ব তার মধ্যে দারুণভাবে কাজ করতো। যে বিষয়টি আমাকে খুব নাড়া দিত। আমরা পাকিস্তানি হতে পারি আমরা তো বাঙালি। ওই সময় খেলাধুলা ছাড়াও আমাদের নানাক্ষেত্রে নিগৃহীত হতে হতো। এটা সে বুঝতো এবং বিষয়টি তাকে নাড়া দিত। তিনি ছিলেন দারুণ স্বাধীণচেতা। নিজেকে বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উদগ্রীব থাকতেন। ’
শহীদ জুয়েলর জন্ম ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৩ সালে শহীদ জুয়েলকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
এইচএল/এমআরএম