কলকাতা: কলকাতার দরজায় কড়া নেড়ে ইতিমধ্যেই শহরে এসে গেছে শীতকাল। নাগরিক সমাজের ব্যস্ত জীবনে পৌষের পিঠে-পুলি কালেভাদ্রে জুটলেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর উৎসবের মেজাজে ভাটা পড়েনি কোনোভাবেই।
আর তাই শীত আসতে না আসতেই মেলামুখী কলকাতার মানুষ। কলাকাতার ‘বই মেলা’ এখনও ঢের দূরে। কিন্তু তাই বলে কোনভাবেই থেমে থাকতে রাজি নয় মেলাপ্রেমীরা। মঙ্গলবার(২৩ ডিসেম্বর) থেকে শান্তিনিকেতনে শুরু হচ্ছে পৌষ মেলা।
প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর ৭ পৌষ এই মেলা শুরু হয়ে চলে তিন দিন ধরে। মেলার ইতিহাসের দিকে নজর রাখলে আমরা দেখতে পাব, ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের পর ‘পৌষ উৎসব’ –এর সূচনা করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন থেকেই এই মেলার শুরু।
এরপর এই মেলা একটি সাধারণ গ্রাম্য মেলা থেকে বাঙলার ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ইতিমধ্যেই নতুন ধান ঘরে তুলেছেন চাষিরা। ধান বিক্রি করে হাতে এসেছে কিছু নগদ অর্থ। তাই মেলার উৎসবে নিজেদের একাত্ম করে নিতে তারা প্রতিবারের মতই উৎসাহী হয়ে উঠবেন এমনটাই আশা সবার।
শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা পশ্চিমবঙ্গের উৎসবগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ জায়গা পেয়ে থাকে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দূরদূরান্ত থেকে হাজির হন বাউলরা। তাদের একতারার সুরে, খোল, ঢোল আর তবলার তালে মেতে ওঠে গোটা শান্তিনিকেতন।
এ বছরের শান্তি নিকেতনের পৌষ মেলায় তিনদিন মঞ্চে বাউল গানের আয়োজন করছেন উদ্যোক্তারা। আর এই সমস্ত বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করে ফেলেছেন মেলার আধিকারিক এবং বিশ্ব ভারতীর কর্মী পরিষদের প্রতিনিধিরা।
প্রতি বছরের মতই দেশবিদেশ থেকে হাজির থাকছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সেই কারণে দমকল বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন মিলে এক নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়েছেন এই মেলা প্রাঙ্গণে।
বিশেষভাবে শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলার শুরুর দিন হাজির থাকছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, সেই কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরও আঁটসাঁট করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মেলা মানেই অসংখ্য মানুষ। আর শান্তি নিকেতনের পৌষমেলায় মানুষের ভিড় প্রতিবছর তার আগের বছরের হিসাব বদলে দেয়। ঠিক এ কারণেই মেলায় কোনোভাবে যাতে দূষণ না ছড়ায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সংগঠকরা জানিয়েছেন- গোটা মেলায় পরিচালনা হবে দূষণ বিরোধী সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান। মেলার সংগঠকদের আশা অন্তত, কিছুটা সময় মেলায় কাটাবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তাই মূল ফটকগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটি ‘ওয়াচ টাওয়ার’ বানানো হয়েছে। যেখান থেকে সর্বক্ষণ নজর রাখবে পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বিভাগের আধিকারিকরা।
শান্তিনিকেতনের হোটেল, গেস্ট হাউজগুলোতে তিল ধারণের ঠাই নেই। দামও বেড়েছে বেশ কিছুটা। অনেক হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ৩ থেকে ৬ মাস আগে অনেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছেন।
শুধু শান্তিনিকেতন নয়, তারপরের স্টেশন প্রান্তিকেও একই অবস্থা। বেশ কিছু গৃহস্থ বাড়িতেও মানুষজন থাকছেন বলে জানা গেল।
মেলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বেশকিছু দিন আগে। মঙ্গলবার থেকে মেলা শুরু হলেও কিছু দোকানে শেষ পর্যায়ের কাজ এখনও চলছে। বিশ্বভারতী কর্মী পরিষদের সম্পাদক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই বছরে পৌষ মেলায় মোট ২ হাজার দোকান থাকছে।
দোকানিরা জানিয়েছে, তাদের আশা ভাল কেনাবেচা হবে এই বছর। তারা মনে করছেন প্রচুর লোকজন আসবেন মেলায়। তবে সমস্যার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
অনেকই জানিয়েছেন মেলার পরিকাঠামোর আরও উন্নতির প্রয়োজন আছে। দোকানিদের প্রায় সবারই মত, মেলার দিন আরও কিছুটা বাড়ালে ভাল হয়। এটা একদিকে যেমন তাদের বিক্রি বাড়ে অন্য দিকে মানুষেরও সুবিধা হয়।
নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকায় কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ। এদিকে চাষিদের এক অংশ জানিয়েছেন ফসল কিছুটা গোলায় তোলা হলেও এখন বাকি মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ এবং যন্ত্রপাতির ভাড়া। অনেকের এখনও কৃষি ঋণের কিস্তি শোধ করা বাকি। কেউ কেউ জানিয়েছেন, এই বছর ফসলের দাম ঠিক মত পাওয়া যায়নি, তাই মেলা কিছুটা ম্লান তাদের কাছে।
তবে সমস্যা থাকলেও তা মেলার উৎসব মুখরতায় বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটায়নি। শয়ে শয়ে খাবারের দোকান, পোড়া মাটির গয়না, পিঠে-পুলির গন্ধ, কাঁচের চুড়ির দোকানে টুংটাং শব্দের সঙ্গে বাউলের দোতারার সুর সব মিলিয়ে জমজমাট হচ্ছে শান্তি নিকেতনের পৌষ মেলা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৪