ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বরিশালের জেলেপল্লী

পুতুলে স্বপ্ন বুনছেন নারীরা

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৬
পুতুলে স্বপ্ন বুনছেন নারীরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরিশাল: পরিবারের ভরণ-পোষণ ও জীবিকার জন্য বরিশালের জেলেপাড়ার সমর্থ্য সব পুরুষেরাই উদয়-অস্ত মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় পার করেন বিক্ষুব্ধ সমুদ্র কিংবা উত্তাল নদীতে।

মাসের অনেকদিনই তাদের রাত কাটে খোলা নদী-সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলারে।

এমনও সময় যায়, টানা ‍রাতের পর রাত তাদের ব্যস্ত সময় কাটে মাছ শিকারে।

সে সময়টাতে বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের আদর্শ গ্রামের জেলেপাড়ায় টানাপড়েনে জর্জরিত প্রতিটি ঘরে আরো বেশি করে দেখা দেয় অর্থের টানাটানি।
মাছ শিকার শেষে বাড়ির পুরুষ বা ছেলেরা ফিরে অনেকটা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মতো করেন। দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের দেনা শোধের পর যেটুকু অর্থ হাতে আসে সেই অর্থ দিয়ে সংসারের চাহিদা মেটে না কোনো পরিবারেই।

তার ওপর রয়েছে বছর-বছর নৌকা সংস্কার, দৈনন্দিন ধার-দেনা পরিশোধ, চিকিৎসা খরচসহ উৎসব-পার্বণের ধাক্কা।

এভাবেই বছরের পর বছর অলিখিত নিয়ম মেনে চলছে বরিশালের বিভিন্ন জেলেপল্লীর মানুষদের জীবন-জীবিকা। কুবের কিংবা মালাদের মতোই হাসি-কান্নায় এভাবেই জীবন পাড়ি দিয়ে আসছিলেন তারা।

কিন্তু সম্প্রতি বরিশালের এসব জেলেপল্লীতে নতুন দিনের স্বপ্ন ও অবলম্বন হয়ে এসেছে সুঁই-সুতার আঁচড়ে হাতে তৈরি কাপড়ের পুতুল। অবসর সময়ে জেলেপল্লীর ঘরে-ঘরে গৃহবধূ-তরুণী-কিশোরীরা তৈরি করছেন হরেক নকশার বাহারি রঙের পুতুল।

এই পুতুল বুনেই জেলেপাড়ার নারীরা সংসারে ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছেন শ্রী। সেইসঙ্গে বুকের গহীনে বুনছেন অনাগত দিনের সাবলম্বী পরিবারের স্বপ্ন।

গ্রামের এসব নারীরা পুতুল তৈরির পাশাপাশি নকশা, পাটি বোনাসহ অন্যান্য হস্তশিল্পের কাজও করছেন।

জেলেরা যখন নদীতে মাছ ধরছেন কিংবা বছরের নির্ধারিত যে সময়গুলোতে মাছ ধরা বন্ধ থাকছে, সে সময়গুলোতে তাদের পরিবারের নারী সদস্যরাই বড় ভূমিকা রাখছেন। জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার পথকে আরো ‍সুগম করছেন তারা।

সরেজমিনে আদর্শ গ্রামের জেলেপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারী সদস্যরা পুতুল তৈরির কাজ করছেন। এছাড়া কেউ সেলাই, কেউ পাটি বুনন, কেউবা নকশার কাজ করছেন।

জেলেপাড়ার গৃহবধূরা জানান, তাদের গ্রামে সুতা দিয়ে পুতুল তৈরির কাজ করতে পারেন এমন অর্ধশতাধিক পরিবারে  শতাধিক নারী রয়েছেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এউএসএআইডিএ’র মাধ্যমে তারা গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে হাতে পুতুল তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

মুন্নি আক্তার ও সমিতা রানী নামে দুই নারীর তত্ত্বাবধানে কাজ শেখার পর এখন তারা নিজেরাই পুতুল তৈরি করছেন। তবে পুতুল তৈরির উপকরণ যেমন কুশি-কাঠা, সুতা, তুলা ও ঝুনঝুনি প্রাথমিকভাবে ওই এনজিও থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে এনজিওটির মাধ্যমে জেলেপাড়ার গৃহবধূদের দল বিদেশে রফতানির জন্য পুতুল তৈরির কাজও পেয়েছেন বলে জানান উচ্ছ্বসিত কয়েকজন গৃহবধূ।

গ্রামের বাসিন্দা জেলে মামুন জানান, গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই নদী কিংবা সাগরে মাছ শিকার করেন। আদর্শ গ্রামের সব জেলেরই কার্ড রয়েছে। এখানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ মাছ শিকার করেন না। যখন নিষেধাজ্ঞা থাকে, তখন সাময়িক বেকারত্ব দেখা দেয় তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে যে চাল ও সহায়তা দেওয়া হয়, তা দিয়ে কিছুটা উপশম হলেও তাদের অন্যত্র কাজের সন্ধান করতে হয়।

তিনি জানান, আবার অনেক জেলে পরিবারকেই দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ করতে হয়। এ কারণে তাদের ঋণের বোঝা বেড়ে যায়।

মামুন জানান, সম্প্রতি পরিবারের নারীরা ছোটখাটো কাজ করে অর্থের যোগান দিচ্ছেন। এটা পরিমাণে অল্প হলেও অনেক সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। ফলে গ্রামের পুরুষরা পরিবারের নারী সদস্যদের হস্তশিল্প ও অন্যান্য কাজে উৎসাহ দিতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি গ্রামের সব মেয়েরা এখন স্কুলেও যাচ্ছে।

এরই মধ্যে পুতুল তৈরির কাজটি গ্রামে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলেও জানান তিনি।

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আব্দুস ছালাম হাওলাদার বলেন, এউএসএআইডিএ’র অর্থায়নে ওয়ার্ল্ড ফিস ও বাংলাদেশ ডিপার্টমেন্ট অব ফিশারিজ পরিচালিত ইকোফিস প্রকল্পের আওতায় ট্রেনিং শেষে পুতুল তৈরির কাজ কয়েক মাস ধরে শুরু হয়েছে এ গ্রামে। এর মাধ্যমে নারীরা নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলবেন ও পরিবারের ব্যয় নির্বাহে নিজেদের অংশীদারিত্ব জোরদার করবেন।

তিনি জানান, পুতুল তৈরির কাজ দেখতে গ্রামের দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসছেন। অনেকেই অর্ডার দেওয়ার কথাও বলেছেন। অল্প সময়েই গ্রামের পরিস্থিতি বদলে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ বৃদ্ধ।

গ্রামের জেলে পরিবারের মেয়ে কিশোরী সুমী আক্তার জানান, প্রশিক্ষণ শেষ হতে না হতেই তারা ৩০০ পিস পুতুল তৈরির অর্ডার পেয়েছেন। এগুলো তাদের ইউনিটে থাকা ৫০ জন নারী সদস্য মিলে করছেন। ডেলিভারি দিতে পারলে আরো কাজ পাওয়া যাবে এবং তা পরিমাণে বাড়বে।

তিনি জানান, বর্তমানে গ্রামের প্রশিক্ষিত নারীরা অক্টোপাস, র‌্যাটেল বানি, ফ্রকগার্ল, ট্রয়টল, অ্যাঞ্জেল, রোবট, বুলেট, শাপলা ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের পুতুল বানাতে পারদর্শী। এসব পুতুল বানাতে সুতা, তুলা, আর ঝুনঝুনি ব্যবহার করছেন তারা।

জেলেবধূ বিউটি বেগম জানান, অনেক পুতুল আছে যা বানাতে দীর্ঘ সময় লাগে। তবে গ্রামের নারীরা বিকেলে অবসর সময়ে সবাই একত্রে বসে গল্পচ্ছলে এসব পুতুল বানান। বর্তমানে তারা ৩০ টাকা মূল্যের অক্টোপাস তৈরির কাজ করছেন।

এদিকে, পুতুল ছাড়াও গ্রামের নারীরা হাতে বোনা পাটি তৈরির কাজ করছেন। এজন্যও তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ১৫০ টাকার হোগলা পাতার একটি আঁটি দিয়ে ৪/৫ হাত দীর্ঘ ৪ থেকে ৬টি বুনছেন তারা।

এসব পাটি বোনার ক্ষেত্রে সময় লাগছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। স্থানীয় বাজারে ওঠার পর পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা ভালো দামে এসব পাটি কিনে নেন বলেও জানান জেলে জব্বার।

এসব কাজের বাইরেও সময় পেলে পরিবারের নারীরা ছাগল পালন ও মুড়ি ভাজার কাজ করছেন। আর সব কাজেই তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করছেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা।

গ্রামের জেলেরা মনে করেন, এভাবে একসময় জেলে পরিবারের কাঁধ থেকে ঋণের বোঝা নামবে, পরিবারে ফিরবে স্বচ্ছলতা। একই স্বপ্ন দেখছেন জেলেপাড়ার নারীরাও।

বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৬
এসআর/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।