ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

আরবের বিপ্লবী উন্মাদনা কেন ভয়ের?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১১
আরবের বিপ্লবী উন্মাদনা কেন ভয়ের?

ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে মিশর নিয়ে প্রবন্ধটি লিখেছেন স্লাভোজ জিজেক। বিখ্যাত দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও মনোবিশ্লেষক স্লাভোজ জিজেকের জন্ম স্লোভেনিয়ায়।

তার তত্ত্বীয় আলোচনা ও লেখালেখিতে হেগেল, কার্ল মার্কস ও জাঁক লাকাঁর প্রভাব রয়েছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত তার বিশ্লেষণটি অনুবাদ করেছেন রানা রায়হান

মিশর ও তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থান সম্পর্কে পশ্চিমা উদারনীতিকদের প্রতিক্রিয়া প্রায়ই ভণ্ডামি ও নৈরাশ্য প্রকাশের সমতুল্য।

তিউনিসিয়া ও মিশরের এ বিক্ষোভে চোখে যা ধরা পড়ছে না তা হলো, মুসলিম মৌলবাদিতার স্পষ্ট অনুপস্থিতি। সবচেয়ে উন্নত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুসারেই, জনগণ স্রেফ নিপীড়নমূলক শাসন, তার দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং একইসঙ্গে স্বাধীনতা ও অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি দাবি করেছে। পশ্চিমা উদারনীতিকদের বাতিকগ্রস্ত জ্ঞানজগতে ও ক্ষুদ্রমনের এলিটদের কাছে আরব দেশগুলোয় প্রকৃত গণতান্ত্রিক উপলব্ধি অত্যন্ত সীমিত, তাদের কাছে বিশাল জনগোষ্ঠী কেবল ধর্মীয় মৌলবাদ অথবা জাতীয়তাবাদ দ্বারা তাড়িত হয়। এটা এখন মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। জরুরি প্রশ্নটা হচ্ছে, এরপর কী ঘটবে? রাজনীতির ময়দানে বিজয়ী হয়ে কার উত্থান ঘটতে যাচ্ছে?

তিউনিসিয়ায় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার মনোনিত করার সময় এতে ইসলামপন্থী ও অতি বামপন্থীদের বাদ রাখা হয়েছিল। এক্ষেত্রে কল্পনাশক্তিহীন এসব উদারনীতিকের প্রতিক্রিয়া ছিল: ভালো, তবে তারা সবাই একইরকম। দুটিই সর্বাত্মকবাদী চরমপন্থা--তবে ব্যাপারগুলো কি এতোই সহজ? দীর্ঘদিন ধরে জিঁইয়ে থাকা সত্যিকার দ্বন্দ্ব কি ইসলামপন্থা ও বামপন্থার মধ্যে না? এমনকি তারা যদি এ মুহূর্তে বর্তমান শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধও হয়, তারপরও তারা যখন বিজয়ী হবে তাদের মধ্যে ফাটল ধরবে, পরস্পর ভয়াবহ লড়াইয়ে মেতে উঠবে যা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়েও নির্মম।

ইরানের গত নির্বাচনে আমরা এরকমই একটি লড়াই কি দেখলাম না? মুসাভির লাখ লাখ সমর্থকরা যে স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উঠেছিল: স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার। এ স্বপ্ন ইউটোপিয়ান (কল্পনা) হলেও তা রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে, সাংগঠনিক অভিজ্ঞতায় এবং ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তর্কবিতর্কে শ্বাসরুদ্ধকর বিস্ফোরণের দিকে নিয়ে যেতো। এই প্রকৃত উন্মোচন যা সামাজিক রূপান্তরের পক্ষে এক অভূতপূর্ব শক্তির আবির্ভাব ঘটায়, তাতে মনে হচ্ছিল সবকিছুই সম্ভব। অথচ ধীরে ধীরে তা ইসলামপন্থা প্রভাব বলয়ের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।

এমনকি স্পষ্টভাবে মৌলবাদী আন্দোলনেও কেউ একজন সামাজিক উপাদান ব্যবহারের সুযোগ যেন না হারায় সে ব্যাপারে সচেতন থাকে। তালেবান গোষ্ঠীকে নিয়মিতভাবে ইসলামি মৌলবাদী গ্রুপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যারা সহিংসতার মধ্য দিয়ে শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টার করছে। তবে ২০০৯-এর বসন্তে সংগঠনটি পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন ছাপে, এটা একটি শ্রেণী বিদ্রোহ। এতে সংখ্যায় অত্যন্ত কম একদল ভূমিমালিক ও ভূমিহীন প্রজাদের মধ্যে গভীর দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরা হয়। তালেবান গোষ্ঠী যদি কৃষকদের দুর্দশার সুবিধা নেয় নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষায় তা হবে, মূলগতভাবে সামন্তীয় দেশ পাকিস্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

একটি বিষয়ে চোখ বন্ধ করে সিদ্ধান্ত টানা যায়, আর তা হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোয় ইসলামি মৌলবাদের উত্থানের অর্থ হচ্ছে ধর্মনিরেপক্ষ বামপন্থার অনুপস্থিতি। আফগানিস্তানকে এখন সবচেয়ে মৌলবাদী ইসলামি দেশ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। অথচ ৪০ বছর আগে এই দেশই বেশ জোরালো ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের দেশ ছিল। এখানে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে ওই পার্টি এখানে স্বতন্ত্র শাসনের ক্ষমতা পেয়েছিল। সেই ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য কোথায় গেল?

আর তিউনিসিয়া ও মিশরে (এবং ইয়েমেন, সম্ভবত সৌদি আরবেও) যা ঘটছে তার পেছনের কারণ অত্যন্ত নির্মম। পরিস্থিতি যদি এমনভাবে শেষ হয়, উদারনীতির কসমেটিক সার্জারির পুরনো শাসন টিকে গেল, তাহলে তা অলঙ্ঘনীয় মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে। প্রধান সব উদারনৈতিক চিন্তাধারা টিকিয়ে রাখার জন্য র‌্যাডিক্যাল বামপন্থীদের ভাইয়ের মতো সহায়তা প্রয়োজন উদারনীতিকদের। মিশরের কথায় ফিরে আসলে, সবচেয়ে লজ্জাজনক ও ভয়ংকরভাবে সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, সিএনএনে এটি সম্প্রচার করা হয়। ব্লেয়ার বলছেন: ‘পরিবর্তন জরুরি, তবে তা হতে হবে মজবুত পরিবর্তন। মিশরে আজ মজবুত পরিবর্তন বলতে কেবল বোঝাবে, শাসকগোষ্ঠীর আয়তন বড় করার মধ্য দিয়ে মোবারকের বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করা। ’ আর এ কারণেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমঝোতা করার কথা বলা অশ্লীলতা। বিরোধীদের বিবেচনায় না নিয়ে মোবারক নিজেই এটা অসম্ভব করে তুলেছেন। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মোবারক সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর পরিষ্কার বোঝা গেল: কসমেটিক পরিবর্তন অথবা একটি অভ্যুত্থান হতে যাচ্ছে। কসমেটিক পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে পুরনো জিনিস (শাসন) একইরকম থেকে যাওয়া।

এখানেই সত্যের মুহূর্ত ধরা পড়ছে: কেউ একজন দাবি করতে পারবে না, অবাধ নির্বাচন আর মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া সমান কথা। আরেকটা উদারনৈতিক উদ্বেগ হচ্ছে, মোবারক যাওয়ার পর কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি নেই, যারা ক্ষমতা নিতে পারে। সব বিরোধী শক্তিকে মোবারক ঠেলে প্রান্তে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং ফলাফলটা হয়েছে কিছুটা আগাথা ক্রিস্টির একটি উপন্যাসের নামের মতো: অতপর সেখানে কেউ ছিল না (অ্যান্ড দেয়ার ওয়্যার নান)।

পশ্চিমা উদারনীতিকদের ইতরতা বেশ মজার: তারা জনসম্মুখে গণতন্ত্রকে সমর্থন দিল। আর এখন ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীনতা ও ন্যায়ের পক্ষে (ধর্মের পক্ষে না) জনগণ বিদ্রোহ করলে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কেন এই দুশ্চিন্তা, স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য কেন আনন্দ উদযাপন হচ্ছে না? আজ যে কোনো সময়ের চেয়ে মাও সেতুঙের কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক: ‘স্বর্গের নিচে মহা হট্টগোল চলছে--পরিস্থিতি বেশ চমৎকার। ’

মোবারক এখন কোথায় যাবেন? এখানে উত্তরটাও পরিষ্কার: হেগ (নেদারল্যান্ডের শহর, এখানে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের কার্যালয় রয়েছে)। যদি কোনো নেতা এখানে বসার যোগ্যতা রাখেন, তাহলে তিনি হচ্ছেন মোবারক।

বাংলদেশ সময়: ০১৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।