সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী অভিযান পরিচালনায় গত ২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুমোদন দেয় দেশটির পার্লামেন্ট। একইদিন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎকার নেয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমস।
এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়ার আইএসবিরোধী অভিযানের মূল্যায়নসহ তার দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সন্ত্রাস দমনে সরকারের অবস্থান ও আইএসসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন।
গত ৬ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে সানডে টাইমস। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্ব বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) প্রকাশ হলো। অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর রাজিউল হাসান।
প্রশ্ন: রাশিয়া কেন এবং কিভাবে সিরিয়ায় অভিযান শুরু করলো? আপনার ও মি. পুতিনের মধ্যে এ ব্যাপারে কি কথা হয়েছে, তার কিছু কি বলবেন? এই অভিযানের ব্যাপারে কে প্রথম উদ্যোগটা নিল? আপনি কি সহায়তা চেয়েছিলেন, নাকি তারাই এগিয়ে এসেছিলো?
বাশার আল-আসাদ: এই প্রশ্নটা রাশিয়ানদেরই করা উচিত ছিল আপনার। তবে আমাদের দিকের কথা যদি বলি, সিরিয়ায় পশ্চিমা অভিযান শুরুর পরও আইএস, আল-নুসরাসহ প্রতিটা জঙ্গি সংগঠন সম্প্রসারিত হচ্ছিলো। এমনকি তারা সিরিয়া ও ইরাকে নতুন আরও বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয় এই এক বছরে। রাশিয়ানরা এসব দেখেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, কিভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলো সিরিয়া, ইরাকসহ পুরো অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। এমনকি তারা রাশিয়াসহ পুরো বিশ্বের জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ইউরোপের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলে আমার কথার সত্যতা পাবেন। প্যারিসে বা শার্লি হেবদোতে যা ঘটেছে, সেগুলো যদি বিচ্ছিন্নভাবে না নিয়ে একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়, তাহলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। ইউরোপে কতোজন জঙ্গি এখন সক্রিয়? ইউরোপ থেকে কতো সংখ্যক জঙ্গি সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে? এই পয়েন্টগুলোতেই বিপদটা লুকিয়ে আছে। বিপদ এখনও ইনকিউবেটরে। রাশিয়ানরা এসব খুব পরিস্কারভাবে দেখতে পেরেছে। তারা সিরিয়া, ইরাক, এই অঞ্চল, তাদের নিজেদের, এমনকি ইউরোপ রক্ষা করতে চায়। তবে আমি বলতে চাইছি না, রুশ সরকার এখনই ইউরোপকে রক্ষা করছে।
প্রশ্ন: তাহলে কি আমরা ধরে নেব, তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছে এবং আপনার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে? নাকি আপনি সহায়তা চেয়েছিলেন?
বাশার আল-আসাদ: এটা আসলে এক ধরনের স্বতস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত, যা নিজে নিজেই দাঁড়িয়ে গেছে। আমার আহ্বানে বা তাদের উদ্যোগে এটা হয়নি। আপনি জানেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে অটুট। এবং সিরিয়ায় সবসময়ই তাদের সেনাপ্রতিনিধি ছিল, যাদেরকে আমরা বিশেষজ্ঞ নামে চিনি। সংকটকালে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রুশ প্রতিনিধি দল আমাদের মতোই এখানকার বাস্তবতা চাক্ষুস করেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কখনোই ঘটনাপ্রবাহ উপর থেকে নিচে প্রবাহিত হয় না। এটা আসে নিচ থেকে উপরের ঘটনাপ্রবাহে। আমাদের দুই দেশের মধ্যে নিয়মিতই রাজনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে আলোচনা হয়। যখন সিদ্ধান্তটা প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে পৌঁছালো, ততোক্ষণে তা যথেষ্ট পরিপক্ক, যা দ্রুত চূড়ান্ত ধাপে যাওয়ার উপযোগী ছিল।
প্রশ্ন: অবশ্যই কোনো না কোনো আনুষ্ঠানিক শুরুর বিষয় ছিল, যা আপনার পক্ষ থেকে কিংবা রাশিয়ানদের পক্ষ থেকে ঘটেছে?
বাশার আল-আসাদ: আবারো বলছি, এই সিদ্ধান্তটা নিম্ন পর্যায় থেকে তৈরি হয়েছে। এই কর্মকর্তারা যৌথভাবে প্রথমে অভিযানের বিষয়ে একমত হন এবং তারপরই নিজ নিজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারা কথা বলেন। যখন বিষয়টা আমাদের পর্যায়ে, অর্থাৎ আমার আর পুতিনের পর্যায়ে পৌঁছালো, আমরা শুধু আলোচনা করলাম কিভাবে তা সম্ভব। এটা সত্যি, সরাসরি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি আমরা। কারণ তখনও পুতিনের সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। আবার টেলিফোনেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা যায় না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্তটা নেই আমরা। সর্বশেষ, প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমি পুতিনকে একটি চিঠি দেই, যাতে সিরিয়ায় সন্ত্রাস মোকাবেলায় আমাদের সহযোগী হতে তাদের আমন্ত্রণ জানাই আমি।
প্রশ্ন: তার মানে, আপনার কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে পুতিনকে আহ্বান জানান আপনি?
বাশার আল-আসাদ: ঠিক। সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আমি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি দেই এবং এ ব্যাপারে একটি যৌথ বিবৃতিও দেই আমরা। তবে ভুলে গেলে চলবে না, তার আগেই সিরীয় বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে সন্ত্রাস মোকাবেলায় পুতিন আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আমার চিঠির বক্তব্য ছিল, আপনি যদি সহযোগিতা করতে আপনার বাহিনী পাঠাতে চান, তাহলে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
প্রশ্ন: কি ধরনের বাহিনী এক্ষেত্রে মাঠে নামানো হয়েছে? আমি আসলে রুশ বাহিনীর কথা জানতে চাইছি। খবর প্রকাশিত হয়েছে, সিরিয়ায় বর্তমানে রুশ নিয়মিত স্থলবাহিনীর পাশাপাশি বিশেষ বাহিনীও অবস্থান করছে। এ খবর কি সঠিক?
বাশার আল-আসাদ: না, এ ধরনের খবর সত্য নয়। রাশিয়ার স্থলবাহিনীর কোনো সদস্যই এখানে নেই। তবে হ্যা, তাদের প্লেন ও বিমানঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কিছু সংখ্যক সেনা এখানে এসেছেন, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সত্যিটা হলো, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিরীয় বাহিনীর সঙ্গে রাশিয়ার কোনো স্থলবাহিনীর সদস্যই কাজ করছে না।
প্রশ্ন: স্থলবাহিনী পাঠানোর ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো পরিকল্পনা কি আছে?
বাশার আল-আসাদ: আমরা এখনও এ ব্যাপারে আলোচনা করিনি। এবং আমি মনে করি না, এখনই তার কোনো প্রয়োজন রয়েছে। কারণ সবকিছু ঠিকভাবেই এগুচ্ছে। রাশিয়ানরা হয়তো এ বিষয়টি ভবিষ্যতে ভিন্ন কোনো পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে পারে, তবে এখন এর কোনো পরিকল্পনা নেই।
প্রশ্ন: খবর রয়েছে, রাশিয়ার কাছ থেকে সিরিয়া এস-৩০০ জঙ্গিবিমান পাচ্ছে, যা সিরিয়ার আকাশ রক্ষা করবে। এ পদক্ষেপের কারণ কি শুধু এটাই, নাকি মার্কিন নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধেও প্লেনগুলো ব্যবহার করা হবে। এমনকি তা যুক্তরাজ্য বা অন্য যেকোনো রাষ্ট্র, যারা আপনার উদ্ধৃত সার্বভৌমত্বের নীতি অমান্য করে সিরিয়ায় ঢুকে পড়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও কি ব্যবহার করা হবে? সিরিয়া যখন প্লেনগুলো পাবে, তখন কি যৌথবাহিনীকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হবে, তাদের আসলে সিরীয় বাহিনীকে মোকাবেলা করতে হবে অথবা স্থলে সহযোগিতা করতে হবে বা এমন কিছু?
বাশার আল-আসাদ: দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিনানুমতিতে প্রবেশের চেষ্টা করা অন্য কোনো দেশের যেকোনো প্লেনই রুখে দেওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে। আমরা যদি এ ধরনের পদক্ষেপ নেই, তা অনৈতিক হবে না। আমাদের আকাশ রক্ষার্থে আমরা যেকোনো কিছু করবো।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে আকাশ প্রতিরক্ষায় আপনার কি যথেষ্ট শক্তি রয়েছে?
বাশার আল-আসাদ: না, এই মুহূর্তে আমাদের তা নেই।
প্রশ্ন: যুদ্ধোপকরণগুলো পেয়ে যাওয়ার পর কি হবে?
বাশার আল-আসাদ: এই মুহূর্তে আমরা প্রথমে সন্ত্রাস নির্মূল করতে চাই। সন্ত্রাসই বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় হুমকি। অবশ্যই আমরা আমাদের আকাশ সুরক্ষিত রাখতে চাই এবং বাইরের কোনো শক্তি আমাদের আকাশ, জল ও স্থলসীমা লঙ্ঘন করুক, তা চাই না। কিন্তু এখন সন্ত্রাস দমনই আমাদের মূল এজেন্ডা। প্রথমে সন্ত্রাস দমন, তারপরই বহিঃশক্তি বিতাড়নের পথে হাঁটবো আমরা।
প্রশ্ন: আমি সিরিয়ার আকাশে উড়ন্ত যৌথবাহিনীর প্লেনগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম?
বাশার আল-আসাদ: তাদের এখনই কিছু বলবো না আমরা। সন্ত্রাস দমন আমাদের প্রথম লক্ষ্য।
প্রশ্ন: সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে সৌদি আরব যদি কোনো আলোচনায় বসতে চায়, আপনি কি আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন?
বাশার আল-আসাদ: বিষয়টা ব্যক্তি ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। এটা নির্ভর করে সরকারগুলোর নীতির ওপর। সিরিয়ার ব্যাপারে তাদের নীতি কি? তারা এখানকার সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে, না কি দিচ্ছে না? সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন এবং অন্য স্থানগুলোয় তারা কি তাদের বিপজ্জনক খেলা অব্যাহত রাখতে চাইছে? এই বিষয়গুলো আগে ভেবে দেখার বিষয়। যদি তারা প্রস্তুত থাকে এবং তাদের নীতির পরিবর্তন করতে আগ্রহী থাকে, বিশেষ করে সিরিয়ার ব্যাপারে, তবেই আলোচনা হতে পারে। কাজেই বিষয়টা আমার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। সিরিয়ার ব্যাপারে তাদের নীতিগত অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। (চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫
আরএইচ
** পশ্চিমা সহায়তা বন্ধ হলে এক মাসের মধ্যে সিরিয়ায় জঙ্গি নির্মূল
** পশ্চিমাদের কারণেই সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান