ঢাকা: সৌদি আরবের জনপ্রিয় শিয়া ধর্মগুরু নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে নতুন করে ঘোলাটে হয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির রাজনীতি।
এমনিতেই বাহরাইন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ওপর নিজেদের অাধিপত্য বজায় রাখা নিয়ে বহুদিন ধরেই চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে এ অঞ্চলের প্রভাবশালী দুই রাষ্ট্র ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে।
যে কোনো সময়ই গুরুতর আকার ধারণ করে পরিস্থিতি এতে জড়িত পক্ষগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের জন্যই যা অশুভ পরিণতি বয়ে আনবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি আরবের কারাগারে বন্দি ছিলেন সৌদি শিয়া সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় ধর্মগুরু শেখ নিমর আল নিমর। ২০১১ সালে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে যে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার প্রতি জোরালো সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন শেখ নিমর। দুই বছর আগে তাকে গ্রেপ্তার করে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। বিচারে বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সহিংসতায় নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সৌদি রাজকীয় আদালত।
ইরানের সঙ্গে শেখ নিমরের ছিলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইরানে দীর্ঘদিন ধর্মীয় শিক্ষাও লাভ করেন তিনি। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করতে তাই সৌদি আরবের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছিলো ইরান। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে‘বড় ধরনের খেসারত‘ দিতে হবে এমন হুমকিও সৌদি আরবকে দিয়ে রেখেছিলো তারা।
এ পরিস্থিতিতে শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি যেন উত্তেজনার আগুনে নতুন করে ঘি’য়ের যোগান।
শনিবার নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরপরই ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ইরান। রোববার রাতে তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ ইরানি জনগণ। নিজেদের দূতাবাসে হামলার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি সৌদি আরব। দূতাবাসে হামলার প্রতিবাদে ইরানের সঙ্গে সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। পাশাপাশি ইরানি দূতাবাস কর্মীদেরও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সৌদি আরব ছাড়ার নির্দেশ দেয় রিয়াদ।
সৌদি আরবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সোমবার ইরানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয় সৌদি আরবের দুই মিত্র রাষ্ট্র বাহরাইন ও সুদান। এছাড়া ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিম্নমাত্রায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় উপসাগরীয় অঞ্চলের অপর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে সৌদি আরবের মিত্র অন্যান্য উপসাগরীয় ও আরব রাষ্ট্রগুলোও এ পদাঙ্ক অনুসরণ করতে যাচ্ছে।
অপরদিকে বসে নেই মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্ররাও। নিমরের মৃত্যুদণ্ডের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি। পাশাপাশি লেবাননের প্রভাবশালী শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহও এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সৌদি আরবকে কঠোর পরিণতির হুমকি দিয়েছেন।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত সৌদি আরবের। ইসলামী বিপ্লবের ইরানে খোমেনির নেতৃত্বে শিয়া ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ায় প্রমাদ গোণে সৌদি আরব। তাদের ভয় ছিলো সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসী শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ বিদ্রোহের ঢেউ আছড়ে পড়বে। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে যখন ১৯৮০-৮৮ সালের ইরাক ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পক্ষ নেয় সৌদি অারব।
দুই দেশের টানাপড়েনের মধ্যেই ১৯৮৭ সালে পবিত্র হজ পালনের সময় পবিত্র হারাম শরীফে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন ২৭৫ জন ইরানি হাজি। ওই ঘটনায় তেহরান জুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা তেহরানে সৌদি দূতাবাসের দখল নেয় এবং কুয়েত দূতাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে দূতাবাসের জানালা থেকে বাইরে পড়ে মুসাদ আল-ঘামদি নামের এক সৌদি কূটনীতিক নিহত হন। এর জেরে সৌদি বাদশাহ ফাহাদ ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
তবে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার পর ১৯৯৭ সালে উভয় দেশের সম্পর্কে ফের সুবাতাস দেখা যায়। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ইরানে আয়োজিত এক ইসলামিক সম্মেলনে অংশ নেন তৎকালীন সৌদি যুবরাজ আবদুল্লাহ। এছাড়া ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো সৌদি আরব সফরে আসেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি। ২০০১’র এপ্রিলে দেশ দু’টির মধ্যে একটি নিরাপত্তা চুক্তি সই হয়।
কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন করে অবনতির সূচনা হয় ২০০৩ সালে। মার্কিন আগ্রাসনে ওই বছর ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পতন হলে দেশটির শাসন ক্ষমতা চলে যায় শিয়াদের হাতে। চিরশত্রু ইরাক রাতারাতি চলে যায় ইরানি বলয়ে।
এছাড়া ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র দেশটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নরম অবস্থানও বিচলিত করে সৌদি আরবকে। পরমাণু অস্ত্রধারী ইরানকে কোনোমতেই বরদাশত করা হবে না বলে জানিয়ে দেয় সৌদি আরব। এমনকি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জবাবে নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি চালুরও হুমকি দেয় তারা।
বাহরাইন নিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে ইরান ও সৌদি আরব।
‘ইরান বাহরাইনের শিয়া জনগোষ্ঠীকে দেশটির বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে’- অনেক দিন ধরেই এমন অভিযোগ করে আসছে সৌদি আরব ও বাহরাইন।
ফলে ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় বাহরাইনে গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভ শুরু হলে তা দমনে বাহরাইন সরকারের সাহায্যে সেনা পাঠায় সৌদি আরব।
অপরদিকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদকে প্রকাশ্যেই সমর্থন দিচ্ছে ইরান। এমনকি সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে বাশার বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে ইরানি সেনারা। সেখানে আবার বাশার বিরোধী সুন্নি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরবসহ অন্যান সুন্নি আরব রাষ্ট্র। এসব সুন্নি বিদ্রোহী গ্রুপ আবার চরমভাবে শিয়া বিদ্বেষী।
লেবাননেও ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের খেলায় লিপ্ত হাসান নাসরুল্লাহর নেতৃত্বাধীন শিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ। অপরদিকে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবাননে সুন্নি বিভিন্ন গ্রুপ ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে খোলাখুলি সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব।
কিন্তু এসব ঘটনায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ২০১৫ সালের শুরুতে। যখন ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর হাদির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজধানী সানার দখল নেয় দেশটির শিয়া হুথি বিদ্রোহীরা।
এ ঘটনা মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে সৌদি আরবকে। আরববিশ্বসহ সারা পৃথিবীতেই ইমেজ সঙ্কটে পড়ে তারা।
ইয়েমেনকে অনেকটা ঘরের পেছনের উঠোন হিসেবে বিবেচনা করে সৌদি আরবের শাসকরা। দেশটির শাসকগোষ্ঠী ও জনগণের সঙ্গেও রয়েছে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইয়েমেনের রাজনীতিতে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপের ইতিহাসও অনেক পুরনো। এ অবস্থায় হুথি বিদ্রোহীরা সানা দখল করে নিলে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে সৌদি আরব।
হুথিদের এই সামরিক সাফল্যের পেছনে ইরানি কলকাঠিকেই মূল কারণ বলে মনে করে সৌদি আরব। তাই কালক্ষেপণ না করে দ্রুত আরব রাষ্ট্রগুলোর একটি জোট গঠন করে সরাসরি হুথিদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে মাঠে নেমে পড়ে সৌদি আরব।
মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটে সৌদি আরব ও ইরানের পক্ষে বিপক্ষে তাদের মিত্রদেশগুলোর বিভিন্নমুখী তৎপরতাও এই দুই দেশের বিদ্বেষের আগুনে আরও জ্বালানি যোগাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বের খ্যাতনামা থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান কারনেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেডারিক ওয়েরির মতে, ১৯৬০ সালের পর হয়তো আর দীর্ঘকাল এমন সময় কখনও আসেনি যখন এতবেশি সংখ্যক আরব রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী এত বেশি সংঘাতে এমন জটিল আকারে জড়িত হয়েছিল। পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে বলেই অভিমত এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর।
দুবাই ভিত্তিক গাল্ফ রিসার্চ সেন্টারের মুস্তাফা আলানি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের চূড়ান্ত ফল হিসেবে সুন্নি প্রভাব খর্ব হয়েছে এবং সৌদি আরবকে অবহেলা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে লেবাননে। ইরান সমর্থিত যোদ্ধারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারকে টিকিয়ে রেখেছে তেমনি ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাকি সেনাবাহিনীর চেয়েও বেশি ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। তার মতে শুরু লেবানন থেকে তারপর লিবিয়া, তারপর ইরাক। আর এখন ইয়েমেন। ’
সব মিলিয়ে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, বাহরাইন এবং সর্বশেষ ইয়েমেন, মূলত পুরো মধ্যপ্রাচ্যই এখন সৌদি আরব ও ইরানের প্রক্সি ওয়ার বা ছায়া যুদ্ধের বিস্তৃত ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
ফলে শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড সৌদি আরব ও ইরানের পারস্পরিক বিদ্বেষকে যে অারও বাড়িয়ে তুলবে তা অনেকটাই অনিবার্য।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৬
আরআই