রাজ্যের বনকর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এই ভয়ানক প্রবণতা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে।
বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ওড়িষ্যায় বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে বন থেকে খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে নেমে আসা ক্ষুধার্ত হাতির সঙ্গে সেলফি তোলার বিপজ্জনক প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে।
ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। জয়কৃষ্ণ নায়ক নামের এক লোক বাজার করে ফেরার সময় গ্রামের রাস্তায় দেখতে পায় একদল ছেলেপুলে হাতির সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য হাতির পেছন পেছন ছুটছে। তাতে সেও বেশ মজা পায়। সেও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে হাতির একদম কাছে গিয়ে সেলফি তুলতে শুরু করে দেয় সে। এসময় বিরক্ত একটি হাতি তাকে শূঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে মাটিতে আছড়ে মারে। তাতে সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়।
‘‘ঘটনাটি ঘটেছে বহু লোকের চোখের সামনে। কিন্তু কেউই তাকে রক্ষা করতেেএগিয়ে যায়নি। বা যেতে সাহস পায়নি। " বিবিসিকে এভাবেই হতাশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নিহতের ছেলে দীপক নায়েক।
সে আরও জানায়, হাতিরা রেগে গেছে দেখে আর সবাই পালাতে শুরু করে। তারা সবাই পারলেও তার বাবা তা পারেনি।
সেপ্টেম্বর মাসেও এমন ঘটনা ঘটে। অশোক ভারতী নামের এক নিরাপত্তারক্ষী হাতির খুব কাছে গিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে হাতির আক্রমণে মারা যায়।
অশোক ভারতীকে যখন ক্ষিপ্ত হাতিটি আক্রমণ চালায়, তখন তাকে বাঁচাতে কেউই এগিয়ে যায়নি। উল্টো সবাই তখন এই ঘটনার ভিডিও করায় ব্যস্ত ছিল।
নিজেকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টায় দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল অশোক। কিন্তু হাতি তাকে পায়ে পিষে মারে। ওই সময় আরো কয়েকজন হাতির আক্রমণে আহত হয়ে প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যায়। ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। কিন্তু তাতিও রাজ্যের তরুণদের টনক নড়েনি। সচেতন না হয়ে তারা বরং হাতির সঙ্গে সেলফি তোলায় আরো বেশি আসক্ত হচ্ছে।
অভিষেক নায়েক নামের এক ছাত্র হাতির খুব কাছে গিয়ে সেলফি তুলতে শুরু করে। বুনো হাতি তখন তার ওপর আক্রমণ চালায়। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গেলেও গলায় ও পেটে গুরুতর জখম নিয়ে ৬ মাস ধরে সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
রাজ্যের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ মোহান্তি বিবিসিকে বলেন, এই রাজ্যে সেলফি তুলতে গিয়ে হাতির আক্রমণে আহত-নিহত হবার অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকা বলে সব ঘটনার খবরও বাইরের দুনিয়ায় বা মিডিয়াতে যায় না। "
আশার কথা, ওড়িষ্যা রাজ্য সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে---জানালেন রাজ্যের প্রধান বন্যপ্রাণী সংরক্ষক সন্দ্বীপ ত্রিপাঠী। তারা এখন এ বিষয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। তারা স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে বুনো হাতির আক্রমণের নকল মহড়ার আয়োজন করবেন। বুনো হাতির খুব কাছে গেলে কি কি বিপদ হতে পারে তা সাধারণ মানুষকে দেখাবেন, সচেতন করবেন।
বুনোহাতির সঙ্গে সেলফি তোলার এই বাতিকের পেছনে শুধু তরুণরাই যে দায়ী, ব্যাপারটা তেমন নয়। বন উজাড়ও দায়ী। ক্রমশ বনবাদাড় উজাড় হয়ে যাওয়ায় হাতির আবাসস্থল ও খাদ্যপ্রাপ্তির সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই বুনো হাতিরা খাদ্যের আশায় গ্রাম ও শহরের কাছে, লোকালয়ের খুব কাছাকাছি চলে আসছে। বিশেষ করে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে হাতিরা খাদ্যের আশায় পাকা ধানের ক্ষেতে দল বেঁধে নেমে আসে। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাচ্ছে অপরিণামদর্শী তরুণরা। বুনো হাতির নিকট-সান্নিধ্যই তাদের এই সর্বনাশা নেশা ও বাহাদুরির লোভে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতেই সেলফি তুলতে গিয়ে হাতির আক্রমণের শিকার হবার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বলে ত্রিপাঠী জানান।
স্থানীয় ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার বি এন মিশ্র বলেন, হাতির যখন দলে দলে লোকালয়ে আসতে শুরু করে দেয় তখন, মানুষের মনেও একটা হৈহৈরৈরৈ ভাব এসে যায়। বিশেষ করে তরুণ-যুবকদের মধ্যে। তারা তখন বুনো হাতির সঙ্গে সেলফি তুলে বাহাদুরি দেখাতে যায়। অতি সাহসে তারা বুনো হাতিদের নাগালের মধ্যে চলে যায়। মোবাইলের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে ওঠামাত্র হাতিরা ক্ষিপ্ত আর মারমুখী হয়ে ওঠে। ক্যামেরার এই ফ্ল্যাশ লাইটই হাতির আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার পেছনে সবচে বড় কারণ।
রত্নাকর দাশ নামের অপর এক বনকর্মকর্তা বলেন, অনেকে সেলফি তোলার জন্য বুনো হাতিকে নিজেদের আখ খেতে নিয়ে যায়। কিন্তু যখনই হাতির কাছে গিয়ে ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট জ্বেলে সেলফি তুলতে শুরু করে তখনই হাতিরা হয়ে ওঠে অশান্ত। তাতেই ঘটে যায় বিপত্তি।
কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি ও দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন এক গবেষণায় জানিয়েছে সারাবিশ্বে সেলফি তুলতে গিয়ে যতো মৃত্যু হচ্ছে, তার বেশিরভাগই হচ্ছে ভারতে। আর ভারতে সেলফিজনিত মৃত্যুতে সবচেয়ে এগিয়ে দরিদ্র রাজ্য ওড়িষ্যা।
দেখা যাক, সেলফিজনিত এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারে কিনা ওড়িষ্যা বা ভারত।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৮
জেএম