এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে ব্যাপক বিরোধিতা, নিন্দা এবং বৈরিতা কুড়াতে পারে জেনেও ফিলিস্তিনি নেতারা এই সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের এই পদক্ষেপ জেরুজালেম প্রশ্নে কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেয়া হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের আকাশছোঁয়া ক্ষোভেরই বহি:প্রকাশ।
ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে তারা রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনের দেওয়া স্বীকৃতি আপাতত স্থগিত করলেন। পাশাপাশি অন্যসব দেশকেও তা করার আহবান জানালেন।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৫ সালেও পিএলও’র সর্বোচ্চ অঙ্গ সংগঠন প্যালেস্টিনিয়ান সেন্ট্রাল কাউন্সিল (পিসিসি) এমনই এক ভোটাভুটির আয়োজন করেছিল। সেটা তারা করেছিল ইসরায়েলের সঙ্গে সকল নিরাপত্তা-সমন্বয় বন্ধের জন্য। কিন্তু সে ভোটাভুটির ফলকে এতোদিন বাস্তবায়ন করা হয়নি। এবারের ভোটে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি স্বীকৃতি প্রত্যাহারের পাশাপাশি ২০১৫ সালের সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করা হলো।
লাখো সাধারণ ফিলিস্তিনি ও তাদের নেতারা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের একক রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতিকে দেখছেন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের গায়ে এক নির্মম কুঠারাঘাত হিসেবে।
ট্রাম্পের হঠকারি সিদ্ধান্ত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চপেটাঘাত
রোববার এ সংক্রান্ত বৈঠক ও ভোটাভুটির উদ্বোধন করেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তিনি ইসরায়েল রাষ্ট্রকে দেয়া ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের পক্ষে ভোটদান শেষে ট্রাম্পের হঠকারি সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেন। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের একক রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতিদানকে তিনি অভিহিত করেন,‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চপেটাঘাত’ হিসেবে।
এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই ভোটের কারণে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে দেয়া স্বীকৃতি স্থগিত রাখবে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলও। পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান এবং অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণকাজ বন্ধ না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে দেয়া স্বীকৃতি স্থগিত থাকবে।
ফিলিস্তিনি নেতারা বিশ্বের অন্যসব দেশকেও তাদের নেয়া উদ্যোগের সমর্থনে ইসরায়েলকে দেয়া স্বীকৃতি স্থগিত রাখার আহবান জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বক্তব্যের প্রতি পূর্ণ সংহতি জানিয়ে পিএলও নেতাদের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে স্বাক্ষরিত যে ওসলো চুক্তিটি ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, সেটির দফারফা হয়ে গেছে ("finished.")।
এর আগে রোববার প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তার বক্তব্যে বলেন, ইসরায়েল ক্রমাগত অপকর্ম ও অব্যাহত বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে চুক্তিটির মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলেছে। এসবের মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ; যা ওসলো চুক্তিতে বর্ণিত ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পথ’ বন্ধ করে দিয়েছে।
মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘‘আমি বলে দিচ্ছি ওসলো, কোনো ওসলো (চুক্তি) আর নেই। ইসরায়েল ওসলোর (ওসলো চুক্তির) মৃত্যু ঘটিয়েছে। ’’
উল্লেখ্য, এই ওসলো চুক্তির আওতায়ই ১৯৯৩ সালে চিরবৈরী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান করে পিএলও তথা ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে বিরোধ থাকলেও রোববারের এই ভোটাভুটিতে সবারই অকুণ্ঠ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ভোটাভুটির উদ্বোধনকালে দেয়া বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ট্রাম্পের নিন্দায় ছিলেন দ্ব্যর্থহীন:‘‘ট্রাম্পকে আমরা ‘না’ বলে দিয়েছি। ’ আমরা তাকে বলেছি, '‘আমরা তোমার অশুভ পাঁয়তারা মেনে নেবো না। ’’
‘‘এটা শতাব্দীর সবচে বড় চপেটাঘাত। আমরা তা মেনে নেবো না। ’’
যুক্তরাষ্ট্র পক্ষপাতদুষ্ট, মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনে অযোগ্য
ট্রাম্পের ছলচাতুরির ‘চূড়ান্ত শান্তি উদ্যোগ’কে নাকচ করে দিয়ে মাহমুদ আব্বাস যুক্তরাষ্ট্রের বদলে আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত এক পক্ষপাতহীন মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া শুরুর দাবি জানান।
মাহমুদ আব্বাস বলেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র পক্ষপাতদুষ্ট। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের যোগ্যতা সে হারিয়েছে।
আব্বাসের বক্তব্য তার মুখোশ খুলে দিয়েছে: নেতানিয়াহু
এ বিষয়ে ইসরায়েল আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে চুপ থাকেননি দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সোমবার ক্ষুব্ধ নেতানিয়াহু বলেন, মাহমুদ আব্বাস যে মন্তব্য করেছেন তাতে তার গোপন মুখোশখানি খসে পড়েছে। তথাকথিত মধ্যপন্থী নেতার মুখোশের আড়াল থেকে তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।
হামাসের প্রতিক্রিয়া
গাজা উপত্যকার ওপর একচ্ছত্র নিযন্ত্রণকারী সশস্ত্র ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস ওসলো চুক্তি এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্বকে কখনোই মেনে নেয়নি। রোববারের ভোটাভুটি ও স্বীকৃতি স্থগিত করার ঘোষণার পর হামাস রোববারের সিদ্ধান্তকে শর্তাধীন স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে, পিএলওকে এখন নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে এবং এজন্য যা যা করণীয় তা করা শুরু করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া
আব্বাসের ক্ষুব্ধ বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা বলেছে, তারা ইসরায়েল –ফিলিস্তিন বিরোধ নিষ্পত্তির প্রশ্নে আগের অবস্থানেই অটল রয়েছে এবং অবশ্যই তা ‘‘ওসলো চুক্তির ভিত্তিতে’’।
ব্রাসেলসে সোমবার সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র মায়া কোসিয়ানসিচ বলেন, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল এই দুই পক্ষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আলোচনার মাধ্যমে একটি দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই হচ্ছে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায়।
রাশিয়া ও ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্স দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে এক বছর আগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজক রাষ্ট্র ফ্রান্স এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানের অনুরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
অপর দিকে রাশিয়া ফিলিস্তিনের নেয়া এই উদ্যোগের যৌক্তিকতার পক্ষে পরোক্ষ সমর্থন জানিয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, বছরের পর বছর ফিলিস্তিনিরা কেবল ছাড় দিয়ে এসেছে, অথচ বিনিময়ে তারা কিছুই পায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
জেএম