জন্মলাভের মধুর আর গুলিতে জখম হবার বেদনাঘন স্মৃতি! এসব নিয়েই শনিবার পাকিস্তানের তালেবান জঙ্গিসঙ্কুল, প্রত্যন্ত পার্বত্য সোয়াত উপত্যকার মিংগোরায় আবার পা রাখলেন মালালা। নোবেল লরিয়েট মালালার কারণে সর্বার্থে-নেতিবাচক-রাষ্ট্র পাকিস্তানের কলঙ্কের বোঝা একটু কমেছে।
মালালা ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারটি যখন মিংগোরায় মালালাদের বাড়ির কাছে অবতরণ করলো, তখন রচিত হলো এক ‘হিরোজ রিটার্ন’! মহতী ব্রত নিয়ে বিশ্বজয় যে করে, তার প্রত্যাবর্তন তো এমনই হবে!
এরপর মালালা গেলেন শহরের ঠিক বাইরেই ছেলেদের একটা স্কুলে। উদ্দেশ্য, সেখানে স্থানীয় মানুষদের উপস্থিতিতে তার মূল্যবান বক্তব্য রাখা। কেমন লেগেছে তার ছেলেবেলা-থেকে-চেনা আপন পরিবেশে ফিরতে? সংবাদ মাধ্যম বলছে, মনের বেদনা তার ধুয়ে গেছে তার ভালোবাসার কূলপ্লাবী আবেগে।
চেনা গাছপালা, মাঠ, পাহাড়, উপত্যকা, আকাশের মেঘমালা, নিসর্গ প্রকৃতি, পশুপাখি আর চেনা আঙিনা, চেনা মানুষের মুখ-সবকিছুর মধ্যে ফিরে আসবার আবেগ! ‘হোম সুইট হোম’ তাকে আবেগকাতর করেছে।
যেন ট্রয় যুদ্ধ শেষে বহুকাল পর অদিসিয়ুস বা ইউলিসিসের বাড়ি ফেরা: ‘ইউলিসিস রিটার্নস টু ইথাকা অ্যাট ডাস্ক উইথ টিয়ার্স ইন হিজ আইজ’
কথাগুলো ঘুরিয়ে যেন মালালার বেলায়ও বলা যায়! আনন্দিত উচ্ছল কিশোরীর মতোই ঘরে ফিরে আপনজনদের সঙ্গে মিশেছেন, হেসেছেন, কেদেছেন, হেঁটেছেন, বাড়ির আঙিনায় পরিবারের সবার সঙ্গে ছবি তুলেছেন।
নিজদেশ পাকিস্তানে মাত্র চারটে দিন থাকবেন মালালা।
তার সঙ্গে এসেছেন মালালা ফান্ড গ্রুপের কর্মকর্তারা। এর মানে নিজের এলাকার মেয়েদের পড়াশুনার সুযোগ সৃষ্টি, সুযোগকে আরও বাড়ানোর ব্রত আছে তার।
২০১২ সাল। মালালার খুলিতে যারা গুলি করেছিল তারা আজ অবাক চোখে তাকে দেখছে! তারা হয়তো বুঝেছে, একটা শরীরকে গুলিতে ঝাঁঝরা করা যায় কিন্তু একটা আদর্শকে হত্যা করা যায় না।
মালালার আদর্শ আজ দুনিয়ার পড়তে-চাওয়া কিশোরীদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। মালালা হয়ে উঠেছে এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। নিষ্ঠা, ত্যাগ আর সাহস থাকলে যে সফলতার পর্বতচূড়ায় পৌঁছা যায়, সেটা মালালা দেখিয়েছেন। দৃষ্টি যখন ওই উঁচুতে, তখন তারে কে আর ঠেকায়! কেইবা তারে টেনে নামায়!
মালালার কারণেই, মালালার গুলিবিদ্ধ হবার কারণেই বুঝিবা এক সময়কার ভয়ঙ্কর বলে কথিত সোয়াত এলাকাটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। যদিও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। সেখানে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বেড়েছে। পাকিস্তান সরকার নিজের মুখরক্ষার জন্য হলেও এলাকাটির দিকে বাড়তি নজর দিয়েছে। মেয়েরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হারে, আগের চেয়ে কম ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে। শুধু মালালা কারণে।
যেন এক লেডি প্রমিথিউস। প্রমিথিউস নামের গ্রিক পুরাণের সেই নায়ক, যে নিজের সর্বনাশের কথা জেনেও মানুষের জন্য আগুন বয়ে এনেছিল পৃথিবীতে। সোয়াত উপত্যকার জন্য, গোটা পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনুন্নত ও পিছিয়েপড়া অঞ্চলগুলোর জন্য মালালাও যেন তেমনি এক লেডি প্রমিথিউস। যার স্বপ্নের আগুন ও মশালের আলোতে আজ সোয়াত ভ্যালি, গোটা দুনিয়া উদ্ভাসিত।
নিজ এলাকায় নেমে প্রথম বক্তৃতা দেবার সময়ে আবেগ তাকে ঘিরে ধরেছিল –আমুণ্ডুনখাগ্র। বিবিসিকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় মালালা বললেনও সেকথা: ‘‘যখন (দেশে ফিরে) প্রথম বক্তৃতাটা দিলাম...চোখের জল বাঁধ মানছিল না আমার। সে যে কী আবেগের ব্যাপার! নিজের দেশে ফিরতে পেরে, নিজের দেশের মাটিতে আবার পা রাখতে পেরে কতো যে খুশী আমি আজ!’’
কিন্তু তার দেশ সন্ত্রাসের আঁতুরঘর, ‘কুকুন অব টেরর’ (‘সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্য’), অপরাষ্ট্র আর অকার্যকর রাষ্ট্র---এরকম বহু নেতিবাচক অভিধায় ভূষিত। তবু ওই দেশটা যে তার জন্মভূমি। তাই পেথু এই দেশটার জন্য তার ভালোবাসার, আবেগের কমতি নেই। সবকিছু মেনে নিয়েও দেশের ছবি তার বুকের মধ্যে আঁকা: ‘একটা কথাই আমি বলবো পাকিস্তানকে আমি ভালোবাসি। আমি একজন পাকিস্তানি। আমি এই দেশটার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে চাই’।
এযেন সৈয়দ মুজতবা আলীর স্মৃতিকথার ঢংয়ে লেখা ‘প্রবাসবন্ধু’ গল্পের আফগান বাবুর্চি আবদুর রহমানের মতো দেশ নিয়ে অসীম দরদগাথা। খারাপ দেশটার জন্যও যে দরদ তার বিশাল গাণ্ধার বৌদ্ধমূর্তির মতো বিরাট দেহগহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছিল: ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম! এই তো আমার জন্মভূমি!’
বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৮
জেএম/