ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

থানায় আসামিদের নির্যাতন, ৫ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২৩
থানায় আসামিদের নির্যাতন, ৫ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ সংগৃহীত ছবি

নাটোর: লালপুর থানা হেফাজতে আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

 

এ ছাড়া আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে আগামীকাল শনিবারের (১৫ জুলাই) মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।  

অভিযোগ ওঠার পাঁচ পুলিশ সদস্য হলেন, বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজিব, লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. উজ্জ্বল হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদ হাসান, ওমর ফারুক ও এক কনস্টেবল।  

নির্যাতনের শিকার আসামিরা হলেন- পাবনার ঈশ্বরদীর ফতেহ মোহাম্মদপুর গ্রামের মো. সোহাগ (৩০), মোকাররমপুর গ্রামের মো. সালাম (৩১), নাটোরের বড়ইগ্রামের নগর গ্রামের মো. শামীম মোল্লা (২৯) ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বারাদি গ্রামের মো. রাকিবুল ইসলামকে (৩০)। গত বুধবার (১২ জুলাই) লালপুর থানা পুলিশ একটি অটোরিকশা ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার এ আসামিদের আদালতে তোলা হয়।

গ্রেপ্তার চার আসামির মধ্যে তিনজনকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) বিকেলে লালপুর আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোসলেম উদ্দীন এ আদেশ দেন।  

লালপুর আমলী আদালতের বেঞ্চ সহকারী আব্দুল্লাহ বিশ্বাস এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দীতে আসামিরা অভিযোগ করেন ওই পাঁচ পুলিশ সদস্য তাদেরকে নির্যাতন করেছেন।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী আবদুল্লাহ বিশ্বাস বলেন, আসামিদের মধ্যে সোহাগ হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ওমর ফারুক। তিনি অন্য আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর জন্য উপস্থাপন করেন। এ সময় চার আসামির মধ্যে রাকিবুল ইসলাম বাদে তিনজনই থানায় পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।  

আগে আসামি মো. সোহাগ হোসেন স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি না হয়ে আদালতের কাছে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, গত রোববার (৯ জুলাই) রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে তাকে তার শ্বশুরবাড়ি উত্তর লালপুর গ্রাম থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। রাত ৯টার দিকে তাকে থানায় নেওয়া হয়। এরপরই ওসি উজ্জ্বল তার চোখ বেঁধে মারতে শুরু করেন। গত ১১ জুলাই রাতে থানা হেফাজতে উজ্জ্বল তার পায়ের তালুতে লাঠি দিয়ে মারধর ও গোপনাঙ্গে লাথি দেন।

এ সময় বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরিফ আল রাজিব তাকে বলেন, যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকার না করি, আমাকে রিমান্ডে নেবে। তারপর এমন মামলা দেবে যাতে করে আমি আমার পরিবার, বৌ-বাচ্চার মুখ দেখতে না পারি।  

অপর আসামি মো. সালাম তার জবানবন্দিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান, ৯ জুলাই রাত ১টার দিকে পুলিশ তাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে ভোর পাঁচটার দিকে তাকে থানায় নেওয়া হয়। গত সোমবার (১০ জুলাই) ওসি থানায় ঢুকেই তাকে চড়-থাপ্পড় দেন। এরপর তাকে থানার ওপর তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এসআই জাহিদ হাসান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ওমর ফারুক শিমুল তার কনিষ্ঠ আঙ্গুলের ওপরে টেবিলের পায়া রেখে চাপ দেন। এতে তার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল মারাত্মকভাবে ক্ষত হয়। তারপর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে টাকনুর ওপর পর্যন্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। ১২ জুলাই আবার তাকে পেটানো হয়। এদিন দুপুরে এসআই ওমর ফারুক শিমুল তার পশ্চাৎদেশে স্টিলের জিআই পাইপ দিয়ে পেটায়। এসআই তাকে হুমকি দেন, যদি ম্যাজিস্ট্রেটের নির্যাতনের কথা বলে তাহলে বিভিন্ন থানায় তার নামে মামলা দেবে ও জামিন হলেই জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে যাবে।

আরেক আসামি শামীম মোল্লা অভিযোগ করেন, পুলিশ তাকে ১০ জুলাই রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তারপর রাস্তায় মারতে মারতে থানায় নিয়ে আসে। ১১ জুলাই সকালে থানার ওপর তলায় নিয়ে গিয়ে একজন কনস্টেবল, এসআই জাহিদ হাসান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুক চোখ বেঁধে টেবিলের নিচে তার মাথা রেখে মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড মারেন। তারপর দুই পা বেঁধে পায়ের তালুতে পেটায় ও বুকে বারবার লাথি দিতে থাকে।  

আসামিরা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোসলেম উদ্দীনের কাছে তাদের শরীরে আঘাত দেখান। তিনি বর্ণনাকৃত পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীতে আসামিদের শরীরে থাকা জখমের কারণ ও শারীরিক পরীক্ষার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রস্তুত করে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন তিনি।  

এদিন নাটোর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. সামিউল ইসলাম আসামিদের মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) আদালতে দাখিল করান। এটি পর্যালোচনা করে অভিযোগকারী তিন আসামির মধ্যে মো. সালাম ও মো. শামীম মোল্লার শরীরে নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পান আদালত। অপর আসামি সোহাগের শরীরে দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন নেই বলে প্রতিবেদন দিয়েছেন চিকিৎসক।

নাটোরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমানকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করে  ‘অভিযুক্ত কর্মকর্তার নিম্নে নয়’ এমন কর্মকর্তাকে তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেন আদালত।

বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজিব, লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. উজ্জ্বল হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদ হাসান ও ওমর ফারুকের কাছ থেকে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের পাওয়া যায়নি।  

এ বিষয়ে নাটোরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান বলেন, অটোরিকশা ছিনতাই মামলার আসামিদের ধরার সময় তারা দৌড়ে পালাতে গেলে কিছু দাগ টাগ হয়েছে। পরে তারা আদালতে নির্যাতনের অভিযোগ করেছে। আদালতের আদেশের কথা শুনেছেন। আদেশের কপি পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৪২ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২৩
এসএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।