ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

যেসব আচরণবিধি মানতে হবে বিচারকদের

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৭
যেসব আচরণবিধি মানতে হবে বিচারকদের

ঢাকা: সংসদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের পদ্ধতি (ষোড়শ সংশোধনী) অবৈধ ঘোষণা করে বিচারকদের জন্য পালনীয় কিছু আচরণবিধি করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। এসব আচরণবিধি না মানলে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে।   

আর যদি কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা বিচারকাজের অযোগ্যতা সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে বা অন্য কোনো সূত্রে প্রধান বিচারপতি জানতে পারেন, এ অভিযোগ তদন্তে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগে তার পরবর্তী দু’জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়ে কমিটি করবেন।

চূড়ান্ত তদন্তের পর প্রধান বিচারপতি অভিযুক্ত বিচারপতিকে অপসারণে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবেন।

এটিই মূলত বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা।

গত মঙ্গলবার (০১ আগস্ট) প্রকাশিত আপিল বিভাগের ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধি করে দেওয়া হয়।  

সেগুলো হলো- ‘বিচার বিভাগের সংরক্ষিত সততা ও স্বাধীনতা রক্ষায় একজন বিচারকের উচ্চতর মান বজায় রেখে বিচারকাজে অংশগ্রহণ করা উচিৎ’।

‘দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্মান রেখে বিচারকের কাজ করা উচিৎ, যেন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় থাকে’।

‘একজন বিচারকের রায় পারিবারিক, সামাজিক বা অন্যান্য সম্পর্কে প্রভাবিত হতে পারবে না। নিজের বা অন্য কারো ব্যক্তিগত স্বার্থে বিচারকাজ প্রভাবিত করা যাবে না’।

‘আইন অনুসারে একজন বিচারকের পেশাদারি যে এখতিয়ার বা ক্ষমতা, তা আইনের প্রতি সম্মান ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। গণদাবি বা সমালোচনার ভয়ে প্রভাবিত হওয়া যাবে না’।

‘প্রত্যেক বিচারককে বিচারকাজ পরিচালনায় ধৈর্যশীল হতে হবে। সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ ও পক্ষপাতহীনভাবে আইনজীবী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে বিচারকাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে’।

‘ঘোষিত রায় বা আদেশ প্রকাশ করতে অযাচিত বিলম্ব করা উচিৎ নয়। দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিৎ। একটি রায় ঘোষণার পর ছয়মাসের বেশি সময় পর স্বাক্ষর করা ঠিক নয়। তার আগেই স্বাক্ষর করতে হবে’।

‘আদালতে মুলতবি বা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা মামলার মেরিটের ক্ষেত্রে বিচারককে প্রকাশ্যে মন্তব্য এড়াতে হবে’।

‘যে ক্ষেত্রে বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা থাকে, সে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের নিজে থেকেই সরে যাওয়া উচিৎ’।

‘কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, কোনো মামলার সঙ্গে আগে সম্পর্ক ছিল বা আগে ওই মামলায় তিনি আইনজীবী হিসেবে লড়েছেন বা মামলার কোনো পক্ষের সঙ্গে বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল- এসব ক্ষেত্রে ওই মামলার বিচারকাজে তিনি নিজেকে অযোগ্য ঘোষণা করবেন’।

‘একজন বিচারক এমন কোনো বিষয়ে শুনানি গ্রহণ করবেন না, যেখানে তার স্ত্রী-সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনেরা কোনোভাবে জড়িত থাকেন। অথবা এমন কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকেন, যার দ্বারা বিচারক প্রভাবিত হতে পারেন’।  

‘বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থায় নিরবচ্ছিন্নতা ও বিচার বিভাগীয় কার্যালয়ের শপথ রক্ষার সনদ থাকতে হবে একজন বিচারকের’।

‘বিচার কার্যালয়ের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ অনুশীলন করতে হবে বিচারককে’।
‘একজন বিচারক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজে বা কোনো সংগঠন বা সমিতির সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত থাকতে পারবেন না’।

একজন বিচারককে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে যে, তিনি জনগণের নজরদারির মধ্যে আছেন। সুতরাং, বিচারকের কার্যালয়ের সম্মানহানি হয় বা জনগণের কাছে অপ্রত্যাশিত- তেমন কোনো কাজ তিনি করবেন না’।

‘দেশ-বিদেশের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বিচারক জড়িত থাকতে পারবেন না’।

‘প্রধান বিচারপতি যদি জানতে চান, একজন বিচারক তার সম্পদের তথ্য তার কাছে প্রকাশ করবেন’।

‘শুধু বিচার করলেই হবে না, এটি দৃশ্যমান হতে হবে যে, একজন বিচারক ন্যায়বিচার করেছেন। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের যে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা, তা তাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যেন নিরপেক্ষতার ওই ধারণা পরিবর্তনের কারণ ঘটে’।

‘আইনজীবী সমিতির কোনো সদস্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে- এমন কেউ তার আদালতে মামলা পরিচালনা করলে সেটি পক্ষদোষে দুষ্ট হবে’।

‘একজন বিচারকের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, শ্যালক, শ্যালিকা বা ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন, যারা আইনজীবী সমিতিতে অনুশীলন করেন- তাদের কাউকে তার আদালতে মামলা পরিচালনার অনুমতি ওই বিচারক দেবেন না’।

‘পরিবারের সদস্য নন, কিন্তু আইনজীবী সমিতির সদস্য- এমন কোনো ব্যক্তিকে কোনো বিচারক তার বাসস্থানে রাখতে পারবেন না বা নিজের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে দেবেন না’।

‘একজন বিচারক জনবিতর্কে অংশ নেবেন না। বিচারাধীন কোনো বিষয় বা রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে প্রকাশ্যে নিজের মত প্রকাশ বা আলোচনায় তিনি অংশ নেবেন না’।
‘একজন বিচারক রায় দেবেন, নিজেদের মধ্যে কথা বলবেন। কিন্তু কোনোভাবেই গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবেন না’।  

‘বিচারক যদি কোনো মামলায় সিদ্ধান্ত দিতে অক্ষম হন, তাহলে তিনি ওই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবেন’।

‘একজন বিচারক নিজেই যুক্তিসঙ্গত পর্যবেক্ষণ দিয়ে নির্ধারণ করবেন যে, তার আচরণ বা তিনি যা করছেন তা সঠিক কি-না’।

‘একজন বিচারককে তার আচরণ ও কাজ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে’।

‘অসদাচরণ ও অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড থেকে একজন বিচারক সব সময় বিরত থাকবেন’।
‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে একজন বিচারককে ব্যক্তিগত চলাফেরা বা সামাজিক মেলামেশা সীমিত রাখার নীতি গ্রহণ করতে হবে’।

‘জজ আদালতে অনুশীলন (মামলা পরিচালনা) করেন- এমন কোনো নিকটাত্মীয়কে বিচারকের এড়িয়ে চলা উচিৎ, যেন কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্বের সন্দেহ কেউ করতে না পারেন’।

‘বিচারকের পরিবারের কোনো সদস্য যদি কোনো মামলার কোনো পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাহলে ওই বিষয়ে বিচারক অংশ নিতে পারবেন না’।

‘আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন এবং মক্কেলকে আইনি  সহযোগিতা দেন- এমন কোনো ব্যক্তিকে বিচারক তার বাসস্থানে স্থান দেবেন না’।

‘একজন বিচারক তার পরিবারের কোনো সদস্যকে এমন কোনো সামাজিক বা অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে দেবেন না, যা তার আদালতের কোনো বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে’।

‘একজন বিচারক কারো সম্পদ ব্যবহার করতে পারবেন না বা কারো কাছ থেকে ঋণ নিতে পারবেন না, যে ব্যক্তির দ্বারা বিচারকাজে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরিবারের সদস্যদেরও এমন কাজ থেকে বিরত রাখবেন’।

‘বিচার বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় একজন বিচারক ব্যক্তিগত চেম্বার ব্যবহার করতে পারবেন না বা আইন পেশায় অংশ নিতে পারবেন না’।

‘বিচারক বা বিচারকের পরিবারের সদস্যরা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে কোনো উপহার চাইবেন না, উপহার গ্রহণ করবেন না বা কোনো ঋণ গ্রহণ করবেন না’।

‘একজন বিচারক শালীনতা বজায় রেখে আদালতে উপস্থিত বিচারপ্রার্থী তথা সাক্ষী, আসামি, বাদী, বিবাদী, আইনজীবী, আদালতের কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রত্যেকের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবেন’।

‘একজন বিচারক বিচার বিভাগীয় দায়িত্বের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো আচার-আচরণ করবেন না’।

‘প্রধান বিচারপতির বেধে দেওয়া সময় অনুসারে একজন বিচারক এজলাসে উঠেবেন ও নামবেন। দৈনন্দিন কার্যতালিকায় থাকা বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি আদালতের সময়সীমার আগে এজলাস ত্যাগ করতে পারবেন না’।

‘কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা বিচারকাজের অযোগ্যতা সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে বা অন্য কোনো সূত্রে যদি প্রধান বিচারপতি জানতে পারেন, সে অভিযোগ তদন্তে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগে তার পরবর্তী দু’জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়ে কমিটি করবেন’।

‘চূড়ান্ত তদন্তের পর প্রধান বিচারপতি অভিযুক্ত বিচারপতিকে অপসারণে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবেন’।

‘উপরোক্ত আচার-আচরণ মেনে না চললে একজন বিচারক অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য করা হবে’।

গত ০৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। অঅর গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আনা ওই সংশোধনী আর টিকলো না।

বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৭
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।