ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, বললেন আইনমন্ত্রী

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৭
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, বললেন আইনমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন আইনমন্ত্রী

ঢাকা: ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রতি দ্বিমত থাকলেও আমরা শ্রদ্ধাশীল’ বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

**বিএনপির মুখে আইনের শাসনের কথা সাজে না

তিনি বলেন, ‘রায়ে যেহেতু আমরা সংক্ষুব্ধ, সেহেতু চিন্তা-ভাবনা করছি, রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) জানানো হবে কি-না। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি’।


 
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্যে তিনি মর্মাহত বলেও উল্লেখ করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। তার যে বক্তব্যগুলো অপ্রাসঙ্গিক, তা এক্সপাঞ্জের উদ্যোগ নেবো’।
 
রায়ের পর তড়িঘড়ি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সভা করাকে দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
 
বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সকালে সচিবালয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলন করেন আইনমন্ত্রী।  
 
তিনি বলেন, ‘রায়ে দ্বিমত থাকলেও আদালত ও বিচার বিভাগের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমরা পাওয়ার কনটেস্টে (ক্ষমতার দ্বন্দ্ব) অবতীর্ণ হইনি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করা হয়েছে। ’
 
‘রায়ের খুটিনাটি বিষয়ে আরও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রিভিউ আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো’।
 
গত ০১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

এর প্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, যেগুলো এই মামলার সঙ্গে, ফ্যাক্ট ইন ইস্যুর সঙ্গে একদমই সম্পর্কিত নয়। তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন’।

‘আমি মনে করি, ওই সকল রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালতের বিচার্য বিষয় হতে পারে না। আমরা তার এসব বক্তব্যে দুঃখিত’।
 
আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি রায়ের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তির কারণে হয়নি। আমি তার এ বক্তব্যে মর্মাহত। প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যও আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য’।
 
‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমাদের নিরীক্ষায় প্রধান বিচারপতির রায়ে যে সব আপত্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য আছে সেগুলো এক্সপাঞ্জের (প্রত্যাহার) উদ্যোগও আমরা নেবো’।
 
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে চাচ্ছেন- এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘না। রায় আইনগতভাবেই মোকবেলা করবো। আমাদের এমন কোনো অভিপ্রায় নেই যে, এটিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা। কিন্তু এখানে যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য আনা হয়েছে, যেসব ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে সেসব গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার জন্য রাজনীতিবিদরা যদি সেসব বক্তব্য ধরে কোনো বক্তব্য দেন, তাহলে আমার মনে হয় না যে, এটি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার শামিল’।
 
সরকার বা বিরোধী দল- কারো পাতা ফাঁদে পা দেবেন না বলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। তার কারণ হচ্ছে, তিনি এটি বলেছেন। আমি তার বক্তব্য গ্রহণ করলাম’।
 
আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সেটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি’।
 
এ দেশ গণতন্ত্রের নয়, এ প্রজাতন্ত্র বিচারকদের- সাবেক প্রধান বিচাপতি এ বি এম খায়রুল হকের বক্তব্যের বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘এটি তার ব্যক্তিগত মন্তব্য। তিনি নিশ্চয়ই যুক্তি দিয়ে তার বক্তব্য সমর্থন করেছেন। আমি তার যুক্তি এখনও পড়িনি। পড়ে সেটির বিষয়ে মন্তব্য করবো’।
 
সরকার এবং বিচার বিভাগ কি মুখোমুখি অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একদমই না’।
 
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে কোনো সংসদ সদস্য যদি যে দল থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, সে দলের বিরদ্ধে ভোট দেন তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চায় দল যখন বলে দেয়, এ ইস্যুটি দলের, যেমন- নো কনফিডেন্স মশান, তখনই কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ কাজ করে। এটিও সংসদে পরিষ্কার করা আছে যে, অ্যাট টাইমস দেয়ার ক্যান বি ফ্রি ভোট’।
 
‘বিচারপতিরা রায়ে বলেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদের জন্য ষোড়শ সংশোধনী বিতর্কিত হবে। সেটি কিন্তু ঠিক নয়। তার কারণ হচ্ছে, তারা জানেন না যে, এটি পার্টি ভোট দেবে না ফ্রি ভোট হবে, এমনও হতে পারে’।

‘আমরা যে খসড়া আইন করেছিলাম, যে পদ্ধতি আমরা দিয়েছিলাম, সে পদ্ধতিতে এটি পার্টি লাইনে ভোট হবে- এমন কথা ছিল না এবং এমন কোনো ইঙ্গিতও ছিল না। সেক্ষেত্রে আমি বলতে পারি যে, ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেটি কিন্তু অত্যন্ত তথ্যনির্ভর নয়’।
 
রায়ে সংশোধনী বাতিলের পর বিচার বিভাগের দায়বদ্ধতা কার কাছে?- প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যেটি করতে চেয়েছিলাম, সংবিধানে বিচার বিভাগের দায়বদ্ধতা সব সময়ই জনগণের কাছে থাকবে। এটিকে কেউ নিয়ে যেতে পারবেন না, কোনো রায়েও নিয়ে যেতে পারবেন না’।
 
তিনি বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীতে আমরা বলেছিলাম একজন বিচারককে অপসারণের কথা’। এখন তাকে শুধু দু’টি কারণে অপসারণ করা যাবে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘একটি হচ্ছে, অসামর্থ্য বা ইনক্যাপাসিটি, আরেকটি হচ্ছে, প্রমাণিত অসাদচারণ। সেক্ষেত্রে আমরা একটি খসড়া আইন করেছিলাম’।

‘কারণ, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬ অনুচ্ছেদ বলে দিয়েছিল, এটির যে প্রসিডিউর, সেটি আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আমরা সে আইন করে দিয়েছিলাম। এটি অত্যন্ত স্পস্ট ছিল যে, সেখানে তদন্তভার থাকবে বিচারপতিদের হাতেই। সেখানে তদন্ত কমিটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতোই ছিল। তাদের কর্তব্য ছিল, তারা অসদাচারণের অভিযোগ তদন্ত করে সংসদের স্পিকারের কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন। স্পিকার সন্তুষ্ট হলে তখন সংসদে উত্থাপন করবেন’।
 
আনিসুল হক বলেন, ‘আমার ধারণা এ পদ্ধতিটি, আমাদের ধারণা ও গণতান্ত্রিক দেশের ধারণা অত্যন্ত স্বচ্ছ। এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কিভাবে বিচার করবেন না করবেন- সেটি কিন্তু আপনারা কেউই দেখতে পারবেন না, তাদের রায় জানতে পারবেন’।

এ রায়ে বিচারকদের একটি আচরণবিধি দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালেও একটি আচরণবিধি দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সেটি অনেকটা আদর্শলিপির মতো- এই এই করতে পারবেন না। কিন্তু না করলে কি হবে, সেটি কিন্তু লেখা ছিল না। আজকে যে আচরণবিধিটি দেওয়া হয়েছে, সেখানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যে- না করিলে কি কি করা হবে’।
 
‘আমার কথা হচ্ছে, আমরা যে ষোড়শ সংশোধনী করেছিলাম, তাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনো অংশেই, কোনোভাবেই, কোনো উপায়েই কিন্তু ক্ষুণ্ন হয়নি। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অত্যন্ত সৃদৃঢ় হয়েছিল’।
 
রিভিউয়ের আবেদন  করবেন কি-না- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। তারপরে খুঁটিনাটি দেখে সে সিদ্ধান্তে উপনীত হবো’।
 
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠক ডাকার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এতোদিন পরে তড়িঘড়ি করে যে বৈঠক ডাকা হয়েছে, তা দুঃখজনক’।
 
গত ০৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।

গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে মূল রায়টি দিয়েছিলেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। সর্বোচ্চ রায়ের ফলে প্রথম দফার মহাজোট সরকারের আমলে আনা সংশোধনীটি বাতিল হয়ে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে চলে এসেছে।

রায়ের পরে গত ০৬ আগস্ট প্রথম সভাও করেছেন পুনর্বহাল হওয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৭
এসকে/এমআইএইচ/বিএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।