ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

রায়ের রিভিউ আবেদনের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৭
রায়ের রিভিউ আবেদনের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। এটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু এ রায়ে সংক্ষুব্ধ, তাই আমরা নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করছি যে, রিভিউ আবেদন করা হবে কি-না? আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। কারণ, রায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনো নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে’।

রায়ের সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি
 
বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সচিবালয়ে সচিবালয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।  

** প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, বললেন আইনমন্ত্রী

গত ০৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে চূড়ান্ত রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ০১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারে পাল্টাপাল্টি
 
পুর্ণাঙ্গ রায় পড়ে অভিমত জানাতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি আমরা পেয়েছি। যেহেতু রায়টি ৭৯৯ পৃষ্ঠার, তাই এটি সম্পূর্ণ পড়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে আমার এটুকু সময় লেগেছে’।
 
তিনি বলেন, ‘এটি দিবালোকের মতো সত্য যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, দ্বিমত থাকলেও সে রায়ের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে’।
 

‘আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই যে, আপিল বিভাগ যেসব যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন, সেসব যুক্তি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার এবং জাতীয় সংসদের কোনোদিনই এ অভিপ্রায় ছিল না যে- কোনো সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন বা খর্ব করা হবে’।
 
আনিসুল হক বলেন, ‘আমাদের বিবেচনায় ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরো সুদৃঢ় এবং স্বচ্ছ হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার মৌলিক মন্ত্র চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ষোড়শ সংশোধনী পাস করি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গণপরিষদে পাসকৃত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা হয়নি। কিন্তু ১৯৭৭ সালের সামরিক শাসন দিয়ে সংশোধিত ৯৬ অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না নিয়েও চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে’।
 
‘আমি মনে করি, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ প্রণীত মূল সংবিধান যেটিকে বুকে ধারণ করে জন্ম নিয়েছে, সেটি অসাংবিধানিক হতে পারে না। সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের বিধান ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ৩৮ শতাংশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশে রয়েছে। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ নিজে তদন্ত করে না তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত প্রমাণের দায়িত্ব দিয়ে থাকে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়।

‘আমরাও অনুরুপ একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেই। আমি বলতে চাই যে, মূল সংবিধানের কোনো বিধানের জুডিশিয়াল রিভিউ হয় কি-না- সে বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে’।
 
‘আমাদের কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরকে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অপসারণ করাটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যর্থতা বলে প্রতীয়মান হয়েছে’- বলেন আইনমন্ত্রী।
 
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করেছি যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি অত্যন্ত অস্বচ্ছ ও নাজুক। তাই এর পরিবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনতা ও তাদের চাকরির নিশ্চয়তা রক্ষা করা হয়েছিল বলেই আমাদের বিশ্বাস’।

‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, ষোড়শ সংশোধনী করে সংসদ বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনো পাওয়ার কনটেস্টে (ক্ষমতার লড়াই) অবতীর্ণ হয় নাই। বরং, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টাই করেছে’।
 
‘পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদকে পরিবর্তন করা হয়নি বলেই আর কখনো ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন করা যাবে না- এ রকম কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কোথাও নেই। রায়ে উল্লেখ রয়েছে যে, আমরা অনেক গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দিয়েছিলাম যুক্তি হিসেবে এবং এটি কোনো যুক্তি নয়’।
 
‘আমি বিনীত ভাবে বলতে চাই যে, সফল গণতন্ত্রে যেসব নীতি অনুসরণ করা হয়, সেগুলোকে যদি উদাহরণ হিসেবে ধরা হয় তাহলে পরে যুক্তি আরো শক্ত হয়। অন্যদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে কনসেপ্ট- এটি শুধু সামরিক স্বৈরশাসকদের বই থেকেই পাওয়া (উদাহরণ, ১৯৬২ সালের আইযুব খানের সংবিধান)। তাই এটি গণতন্ত্রের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খায় না’।
 
প্রধান বিচারপতির রায়ে উল্লেখিত কিছু বক্তব্য শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা- যেগুলো এ মামলার যে ফ্যাক্ট ইন ইস্যুর সঙ্গে একদমই সম্পর্কিত নয়- সে রকম বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এ প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আমি মনে করি, ওই সকল রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালতের কর্তৃক বিচার্য বিষয় হতে পারে না। আমরা তার এসব বক্তব্যেও দুঃখিত’।
 
‘তিনি রায়ের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তির কারণে হয়নি। আমি তার এ বক্তব্যে মর্মাহত। আমরা স্মরণ করতে চাই যে, ইতিহাস বলে, ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত যে আন্দোলনগুলো হয়েছে তারই ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু হয়তো পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, কিন্তু তারই নেতৃত্বে, তারই আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল’।
 
তিনি বলেন, ‘এটি ভুললে চলবে না যে, জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ছাড়া এ দেশের আর কেউ ১৩ বছরের বেশি কারাভোগ করেননি’।
 
‘তাই প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য’।
 
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিহাস এ কথাও বলে যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জনগণের দেওয়া ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন’।
 
‘আজ স্বাধীনতা ৪৬ বছর পর এ বাস্তব সত্যকে পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে- সেটিই আমার জন্য অনেক কষ্টের এবং লজ্জার। তাই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আমাদের নিরীক্ষায় প্রধান বিচারপতির রায়ে যেসব আপত্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য আছে- সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগও আমরা নেবো’।
 
আইনমন্ত্রী বলেন, দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অপরাধীদের নৈরাজ্য, অপসংস্কৃতি এবং গণতন্ত্রকে ভুলুন্ঠিত করা প্রথা থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারই মুক্ত করেছে। তাই রায়ে যখন উল্লেখ থাকে যে, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করছি ষোড়শ সংশোধনী দিয়ে, তখন ব্যথিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না’।
 
‘প্রধান বিচারপতি মামলার ফ্যাক্ট ইন ইস্যুর বাইরে গিয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী বলে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতেও আমরা বিষ্মিত হয়েছি। আমরা ধন্যবাদ জানাই সেই চারজন বিচারপতিকে, যারা তার ওই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আর শুধু এটুকু বলতে চাই যে, এই ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী আখ্যায়িত করায় আমার মনে হয় যে, প্রধান বিচারপতির যে রায়, তা যুক্তিতাড়িত নয়, বরং আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত'।

‌আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে যে, প্রধান বিচারপতির আসন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং যেকোনো ব্যক্তি সেই আসন অলঙ্কৃত করলে তাকেও আমরা সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক করে ফেলি। তাই আমাদের সকলের দায়িত্ব- এই প্রাতিষ্ঠানিক আসনটির মর্যাদা রক্ষা করা’।
 
‘আমি শুধু বলতে চাই, ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বড় এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ে দেশ বড়’- বলেন আইনমন্ত্রী।
 
সংবাদ সম্মেলনে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক উপস্থিত ছিলেন।
 

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৭
এসকে/এমআইএইচ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।