পঞ্চগড়: পড়তে পারেননি নামিদামি স্কুল কলেজে। এরপরও টানা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন।
দয়াল উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীদ্বার গ্রামের দরিদ্র কৃষক পুলিন চন্দ্র বর্মণ ও কুসলা রানী দম্পতির একমাত্র সন্তান। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজে গেলেও এক সময় বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া। তবে হাল ছাড়েননি তিনি।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিকে অংশ নিয়েছেন এই দয়াল। দরিদ্র বাবাকে কৃষি কাজে সহযোগিতা, সেই সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেন ও স্থানীয়দের বাহবা পাচ্ছেন তিনি। ফসলি জমিতে কাজ করতে করতেই দয়াল অনর্গল কথা বলেন ইংরেজিতে। উচ্চারণ এত চমৎকার যে, কথা শুনে চমকে যেতে হয়।
মাধ্যমিকে জীবন কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় দয়ালের। স্বজনরা অনেকেই থাকেন ভারতে। তার পরিবার চাচ্ছিল, দয়াল যেন ভারতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা নেন, কিন্তু দয়ালের দেশেই কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল। এমন দোটানায় এক সময় লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যায় তার।
তবে ছেলে চিকিৎসক-প্রকৌশলী কিংবা বড় চাকরিজীবী হোক, সন্তানকে নিয়ে এমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না বাবা পুলিন চন্দ্র বর্মন ও মা কুসলা রানীর। চাওয়াটা ছিল খুব সরল। যেন ইংরেজিতে সুন্দর করে কথা বলতে পারে তাদের সন্তান। তবে ঘরবন্দি সময়ে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বাবার কাছে ল্যাপটপ চান দয়াল।
পরে ২০১৭ সালের দয়ালের বাবা পুলিন তার চার বিঘার জমি থেকে কিছু জমি বন্ধক রেখে ছেলেকে কিনে দেন একটি ল্যাপটপ। আর সেই ল্যাপটপে ইউটিউবে বিভিন্ন অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তাদের ভিডিও দেখতে শুরু করেন সে। বিভিন্ন ভিডিও দেখে দেখে নিজেও ইংরেজি বলার চেষ্টা করতে শুরু করেন।
দয়াল চন্দ্র বর্মণ বাংলানিউজকে বলেন, ইংরেজি শেখার খুব ইচ্ছে ছিল। সেই থেকে শেখা শুরু। শুরুতে একসময় আমার মনে হলো, ইংরেজিটা ভালোই বলতে পারছি। ফোনে নিজের ভিডিও ধারণ করে ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা শুরু করি। এরইমধ্যে অনলাইনে ইংরেজি চর্চার প্ল্যাটফর্ম, ‘সার্চ ইংলিশ’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হই।
তিনি বলেন, অন্যদের ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের ভিডিও গ্রুপে আপলোড করতে শুরু করি। যেই কাজ শুরু, সেই মন্তব্যের ঘরে মানুষের প্রশংসা পাওয়া শুরু। এ থেকে আমার নিজের পেজের ফলোয়ার বেড়ে যায়। পেজ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা, নিজের লেখাপড়া ও স্থানীয় গরীব অসহায়দের সহযোগিতা করে আসছি।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাচ্ছি। আমি যে ইংরেজি জ্ঞান অর্জন করেছি, তা এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। সব শেষে বলব, ড্রপ আউট হলেও হবো বেস্ট ড্রপ আউট... যেটাই হও, বেস্টটা হও।
কথা হয় দয়ালের বাবা পুলিন চন্দ্র বর্মনের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ছেলে দয়ালকে সঙ্গে নিয়ে ফসলের মাঠে কাজে যাওয়ার সময় ইংরেজি শিখতে হবে তাকে বারবার বলতাম। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে সে। সে ইংরেজি বলতে পারে বলে আমরা অনেক খুশি। সবাই আশীর্বাদ করবেন ছেলের জন্য। ছেলের জন্য দোয়া ও সহযোগিতার পাশাপাশি সরকারের কাছে সুদৃষ্টি কামনা করছি।
মা কুসলা রানী বলেন, আমার একমাত্র ছেলে দয়াল আমাদের গর্ব। সহজ-সরল আমার এই ছেলে কবে বড় হলো, ভাবতেই পারছি না। আজ অনেক ছেলে-মেয়ে তার কাছে ইংরেজি শিখতে আসে। তা দেখে অনেক ভালো লাগে।
স্থানীয় যুবক বকুল চন্দ্র বর্মণ বলেন, দয়াল আমাদের এলাকার জন্য সুনাম এনে দিয়েছেন। আমরা তার মাধ্যমে অনেকটাই অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমরাও ইংরেজি শেখা শুরু করেছি।
একই কথা বলেন শিক্ষার্থী শান্তা রাণী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দয়াল দাদার ইংরেজি শুনতে খুব ভালো লাগে। আমরা তাকে দেখে চেষ্টা করছি শেখার। আমাদের এলাকার জন্য আইডল তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২৩
আরএইচ