ঢাকা: দেশের কোথাও বড় ধরনের নৌ দুর্ঘটনা ঘটলে কবলিত যানটি বৈধ ছিল কিনা, সংশ্লিষ্ট পথে চলাচলের অনুমতি ছিল কিনা- নানা প্রশ্ন ওঠে। ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে সর্বশেষ একটি দুর্ঘটনা ঘটে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীর অংশে।
বাংলানিউজের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপথে চলাচলকারী নৌযানের পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোয় নেই। ফলে দেশে অবৈধ নৌযানের তথ্যও তাদের কাছে নেই। শুধু নিবন্ধিত নৌযানের তথ্য সংরক্ষণ করে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর।
তবে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র মতে, বৈধ নৌযানের চেয়ে অবৈধের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। বিশেষজ্ঞ ও নৌ-খাত নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের দাবি, এতে নৌ নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
নৌ চলাচল খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৪ হাজার ৮০৫। এর মধ্যে লঞ্চ ও ট্রলারসহ যাত্রীবাহী অন্যান্য নৌযান ৮৪৭টি, ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবাহী নৌকা ৪২২টি ও স্পিডবোট ৭৭৮টি। এ ছাড়া মালবাহী ৩ হাজার ৫৯১টি, বালুবাহী ৫ হাজার ৩৩৬টি, ড্রেজার ১ হাজার ৫২৮টি, পণ্যবাহী ১ হাজার ১৬টি, বার্জ ৫০৩টি, টাগবোট ১৬৩টি ও ফেরি ৪৪টি। বাকিগুলো অন্যান্য নৌযান।
তবে, এসব তথ্যের সঙ্গে একই সংস্থার সাবেক দুই মহাপরিচালকের (ডিজি) জোরালো দ্বিমত রয়েছে। নৌ অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি কমোডোর যোবায়ের আহমেদ বলেছেন, নিবন্ধিত নৌযানের বাইরে আরও প্রায় দুই লাখ অবৈধ নৌযান চলাচল করে। ডিজি থাকাকালে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ‘হাউ টু প্রিভেন্ট লঞ্চ ডিজাস্টার?’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ তথ্য প্রকাশ করেন তিনি।
এর আগে ২০১০ সালে একই অধিদপ্তরের তৎকালীন ডিজি রিয়ার অ্যাডমিরাল বজলুর রহমান নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ খাতে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১১ হাজার ৩০৮; যার মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক সার্ভে হয় আনুমানিক ছয় হাজারের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে যন্ত্রচালিত অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এতে অভ্যন্তরীণ নৌ নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে এবং প্রায় প্রতিনিয়তই নৌযান দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অবৈধ নৌযান চলাচল করায় সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নৌ পরিবহন আইন ‘অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬’র অধীনে প্রণীত বিধি এবং এ সংক্রান্ত দপ্তর আদেশ রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সর্বনিম্ন ১৬ হর্স পাওয়ার (অশ্বশক্তি) ক্ষমতাসম্পন্ন অথবা ১২ জনের অধিক যাত্রী ধারণ ক্ষমতার ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচলের জন্য নকসা অনুমোদন, নিবন্ধন ও সার্ভে (ফিটনেস) বাধ্যতামূলক। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে ডুবে যাওয়া নৌকাটি যন্ত্রচালিত ছিল এবং এর আয়তন ছিল ১২ জনের অনেক বেশি যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ইঞ্জিন, নিবন্ধন ও ফিটনেস ছিল না। ফলে চলাচলের জন্য রুট পারমিট এবং নদী ও নৌপথ নির্ধারিত ছিল না। সুতরাং আইনের দৃষ্টিতে নৌকাটি ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের হাতে নৌযানের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ফলে এর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, যা বহু আগের। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, নিবন্ধিত নৌযানের চেয়ে অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। নৌ শুমারির মাধ্যমেই নৌযানের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি সম্ভব বলে ড. মীর তারেক আলী অভিমত ব্যক্ত করেন।
নাগরিক সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী নিজেই আন্তরিক ও সচেষ্ট। অথচ দেশে অসংখ্য অবৈধ নৌযান চলাচল করছে, মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে। এটা খুবই দুঃখজনক। নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে অবিলম্বে নৌ শুমারি শুরুর তাগিদ দেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩
টিএ/এমজে