চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের মিটার চুরি হচ্ছে অহরহ। শুধু চুরিই নয় মিটার ফেরত পেতে উল্টো মালিকের কাছেই চিরকুট লিখে টাকা দাবি করছে চোরের দল।
অন্যদিকে শিবগঞ্জ পৌর এলাকায় চুরি হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের সংযোগ তারও। এসব ঘটনায় জড়িতরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত ২৭ জানুয়ারি এক রাতেই সদর উপজেলার রানিহাটী ও মহারাজপুর ইউনিয়নের পৃথক কয়েকটি স্থানে এসব চুরির ঘটনা ঘটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে।
সদর উপজেলার রানিহাটী ইউনিয়নের ঝিল্লিপাড়া গ্রামের তহুরুল ইসলাম, একই গ্রামের শহিদুল ইসলাম, চুনাখালী গ্রামের মনিরুল ইসলাম। মহারাজপুর ইউনিয়নের মেলার মোড়ের ‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠানে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ঝিল্লিপাড়া গ্রামের তহুরুল ইসলাম জানান, তার ও আশপাশের বাড়িতে এক রাতেই তিনটি মিটার চুরি গেছে। চোর চক্র বৈদ্যুতিক মিটারগুলো চুরির পর চিরকুটে একটি মোবাইল নম্বর রেখে যায়। মিটারের গ্রাহকেরা ওই মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে তাদের কাছে প্রতিটি মিটারের দাম পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা হয়। এ টাকা ওই নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়। আর টাকা না দিয়ে মিটার লাগালে আবারও মিটার চুরির হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
চুনাখালী গ্রামের মনিরুল ইসলাম জানান, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের পক্ষ থেকে থানায় মিটার চুরির ঘটনার অভিযোগ করা হলেও চোর গ্রেপ্তার হচ্ছে না। এতে বৈদ্যুতিক মিটার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গ্রাহকরা। সদর মডেল থানায় একাধিক অভিযোগ করেও প্রতিকার না পাওয়ায় টাকা দিলে মিটার মিলছে। আর না দিলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এতে গ্রাহকদের টাকা ও হয়রানি দুটোই হতে হচ্ছে।
শহিদুল ইসলাম জানান, এভাবে বৈদ্যুতিক মিটার হারিয়ে টাকা দিয়ে মিটার নেওয়ার পর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে খরচ দিয়ে মিটার লাগানোসহ বিভিন্ন হয়রানিতে ক্ষুদ্ধ ও হতাশাগ্রস্ত তার মতো অন্যান্য ভুক্তভোগীরাও। জেলায় বৈদ্যুতিক মিটার চোর চক্রের হোতাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে জরুরিভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি এই গ্রাহকের।
‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ২৭ জানুয়ারি গভীর রাতে ‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ (কোল্ড স্টোর) এর মিটার পল্লী বিদ্যুৎ এর পোল থেকে চুরি করে নিয়ে যায় চোরেরা। যার মিটার নম্বর-২২৪৪৭২২৭। পরে চোরের দল মিটার চুরি করে চলে যাওয়ার সময় একটি চিরকুটে ০১৮২৯-৯৫৯৭৬৬ নম্বর লিখে যোগাযোগ করার জন্য বলে যায়। পরবর্তীতে চোর চক্রের দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করেন ‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ এর প্রতিনিধি ফ্যাক্টরি ইনচার্জ মো. তারেক। মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে ওই নম্বরে (মোবাইল ব্যাংকিং নগদ) পাঁচ হাজার টাকা পাঠানোর জন্য বলে চোর চক্রের হোতা। চোর চক্রের হোতার সঙ্গে দেনদরবার করে দুই হাজার টাকা চুক্তি হয়। ওই নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিং এ দুই হাজার টাকা পাঠালে মিটারটি ‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ (কোল্ড স্টোর) এর পাশে একটি বালু ঢিবির ভেতর পুঁতে রাখা আছে বলে জানালে সেখান থেকে মিটারটি উদ্ধার করেন তারা। পরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে প্রয়োজনীয় ফি জমা দিয়ে মিটারটি পুনরায় সংশ্লিষ্ট স্থানে লাগানো হয়।
এ ঘটনার পরদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ (কোল্ড স্টোর) কর্তৃপক্ষ। অভিযোগে এর আগেও ‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ (কোল্ড স্টোর) এর একটি ট্র্যান্সফরমার চুরির বিষয়টি উল্লেখ করা হয় এবং মোটা অংকের টাকা খরচ করে পুনরায় ট্র্যান্সফরমারটি লাগাতে হয়।
‘চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ এর প্রতিনিধি ফ্যাক্টরি ইনচার্জ মো. তারেক ট্র্যান্সফরমার ও মিটার চুরির সত্যতা স্বীকার করে জানান, সাধারণ চোর পোলে উঠে মিটার খুলে নিয়ে যাওয়ার সাহস করবে না। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক মিটার খুলেছে। মিটার যেখানে থাকে সেই জায়গা থেকে ৩৩ হাজার ভোল্টের তারের দূরত্ব খুব বেশি নয়, যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও চোর চক্র মিটার চুরি করে ও জিম্মি করে টাকা আদায় করছে এবং গ্রাহকদের হয়রানি করছে কীভাবে? এরপরও কেন তারা আইনের আওতায় আসছে না, যা বোধগম্য নয়। সদর মডেল থানায় অভিযোগ দেয়াও কয়েকদিন হয়ে যাচ্ছে, তারপরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ প্রশাসন। বিষয়টি কেমন রহস্যজনক মনে হচ্ছে।
সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিন্টু রহমান বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে চোর শনাক্তের চেষ্টা চলছে। চুরি রোধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। চিরকুটে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরগুলো ধরে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দ্রুতই এসব ঘটনার অগ্রগতি গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেওয়া হবে। ঘটনার সূত্র ধরে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
মহারাজপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহ-মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. আমিনুর রসুল বলেন, সম্প্রতি পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন কয়েকটি এলাকায় মিটার চুরি বেড়েছে। বিশেষ করে রানিহাটী ও মহারাজপুর ইউনিয়নে এসব ঘটনা বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, চিরকুটের ফোন নম্বর দেওয়া এবং সেই নম্বর থেকে টাকা দাবি করার ঘটনায় পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করছে। আশা করি চোর চক্রকে শনাক্ত করে আটক করতে পারবে। তবে পুলিশকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
অন্যদিকে শিবগঞ্জ পৌর এলাকায় নেসকোর আওতাধীন বিভিন্ন বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে বৈদ্যুতিক সংযোগের তার।
ভুক্তভোগীরা জানায়, মিটার থেকে বৈদ্যুতিক পোল পর্যন্ত সংযোগ তার টুকু কেটে নিচ্ছে চোরের একটি দল। তবে থানায় কেউ অভিযোগ না করায় পার পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা দাবি পুলিশের।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন শওকাত জানান, গত ২৫ ডিসেম্বর এক রাতেই পৌর এলাকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ১১টি বাড়ির তার চুরি করে পৌর এলাকার দৌলতপুর উপরটোলা গ্রামের হাবিবুর রহমান হাদি নামে এক চোর। তার সঙ্গে আরও তিনজন থাকলেও তারা পালিয়ে যায়। পরে তাকে স্থানীয় জনতা আটকে রেখে পুলিশে দেয়।
শিবগঞ্জ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌর এলাকার কারবালা মোড়ের বাসিন্দা শিউলি বেগম জানান, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে তার বাড়ির বিদ্যুৎ লাইন থেকে বাড়ির মিটার পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার টাকার তার চুরি হয়ে গেছে। তবে তিনি থানায় কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানান।
একই এলাকার আলিম মাস্টার বলেন, তার ও পাশের আরও তিনজনের তার চুরি হয়েছে। পরে বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে তার কিনে পুনঃসংযোগ করাতে হয়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র তারগুলো চুরি করছে। তবে বিষয়টিকে ছোট করে দেখায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ লিখিত অভিযোগ করে না, তাই চোরেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পৌর এলাকার জগন্নাথপুর মহল্লার ফটিক জানান, হাদি ও তার তিন সহযোগী তার বাড়িসহ এলাকায় অন্তত ৫০টি বাড়ির তার চুরির সঙ্গে জড়িত। তবে বর্তমানে তাদের চক্রটি জেলে থাকায় গত এক মাসে তার চুরি বন্ধ রয়েছে।
হাদির এক প্রতিবেশী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, তিনি এলাকায় বেশ ভদ্র ও অটোরিকশাচালক হলেও বৈদ্যুতিক তার চুরির চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে একজন মাদরাসার হাফেজও মাদক সেবনের কারণে এ চক্রে জড়িত। তবে এ চক্রটি উপরটোলা এলাকায় তার চুরি করে না বা এ এলাকায় কোনো বাড়ির তারও চুরি হয় না।
তবে অভিযুক্ত হাদির বাবা সমুর উদ্দিন দাবি করে বলেন, বর্তমানে আমার ছেলে তার চুরির মিথ্যা অভিযোগে জেলে আছে। হাদি অটোরিকশা চালায়। তিনজন চোর সেদিন হাদিকে কন্টাক করে তার চুরির পর সেগুলি অটোরিকশায় করে অন্যত্র বিক্রি করতে যাচ্ছিল। সেসময় আমার ছেলে হাদি আটক হলেও মূল চোরেরা পালিয়ে যায়। এসময় তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, আমার ছেলে জেলে থাকলেও এখন তাহলে কারা তার চুরি করছে?
এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) সুকোমল দেব জানান, তার চুরির ঘটনায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। ২৫ ডিসেম্বর তারসহ পৌর এলাকার উপরটোলা গ্রামের হাদিকে স্থানীয়দের সহায়তায় আটকের পর সংশ্লিষ্ট ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। এর আগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও দুই সহযোগীকে আটক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২৪
আরএ