ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

লিবিয়ায় দালালের ফাঁদে ফরিদপুরের ২০ যুবক, দিশেহারা পরিবার!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০২৪
লিবিয়ায় দালালের ফাঁদে ফরিদপুরের ২০ যুবক, দিশেহারা পরিবার!

ফরিদপুর: উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় গিয়ে মাফিয়াদের ভয়ে শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার দুই যুবকের। মাফিয়া চক্রের হাত থেকে ছুটে দেশটিতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

শুধু তাই নয়, উল্টো ওই চক্রের এক সদস্যের স্ত্রীর করা মানবপাচার আইনে মামলায় আতঙ্কে দিন কাটছে ওই দুই পরিবারের সদস্যদের।  

ভুক্তভোগী দুই যুবক হলেন- সালথার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তপুর গ্রামের অহিদ ফকিরের ছেলে শান্ত ফকির (২২) ও লালমিয়া ফকিরের ছেলে হারুন ফকির (৩০)। গত সাত মাস আগে ওই গ্রামের মানবপাচারকারী সদস্য (লিবিয়া মাফিয়া চক্র) মকবুল ঠাকুর ওরফে মুকুল ঠাকুরের (৪৬) প্রলোভনে পড়ে তারা লিবিয়ায় পাড়ি জমান।

এই মুকুল ঠাকুর প্রায় ২০ বছর লিবিয়াতে অবস্থান করছেন। মাঝে মধ্যে ছুটিতে এসে তরুণদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে থাকেন। আর সেখানে তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। সেই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ঘোর অমানিশা নেমে আসে তাদের জীবনে।  

জানা গেছে, মকুল ঠাকুরের হাত ধরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকার অন্ততপক্ষে ২০ জন যুবক লিবিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সেখান থেকে মাত্র চারজন যুবক ইতালি পৌঁছেছেন। বাকিরা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়াতেই অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে অনেকের পরিবারের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকাও আদায় করে নিয়েছে চক্রটি।  

মুকুল ঠাকুরের প্রলোভনে পড়ে লিবিয়ায় যাওয়া যুবকদের মধ্যে রয়েছেন, রামকান্তপুর গ্রামের হারুন ফকির, মোফাজ্জেল মোল্যা, জিহাদুল ইসলাম, রাজিব বিশ্বাস, বাশার মোল্যা, হাসিবুল মোল্যা, হাছান মাতুব্বর, নাঈম মাতুব্বর, তোতা মাতুব্বর, শাকিল মিয়া, শান্ত ফকির, ইশারত মোল্যা ও রাজিব বিশ্বাস।  

ইতালি যাওয়া চার যুবকের মধ্যে রয়েছেন- একই গ্রামের হাসিব ফকির, রনি মিয়া, জিহাদ মিয়া ও শৈলডুবী গ্রামের ফরিদ ফকির।  

এছাড়া বিভিন্ন এলাকার আরও কয়েক যুবককে লিবিয়া পাঠিয়েছেন মুকুল ঠাকুর। এদের মধ্যে বেশির ভাগই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। দেশে থাকা তার ভাই আকরাম ঠাকুর এই যুবকদের ফুসলিয়ে থাকেন এবং টাকা তোলার দায়িত্ব নেন।

ভুক্তভোগীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুকুল ঠাকুরের প্রলোভনে পরে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি শান্ত ফকির, হারুন ফকির ও শাকিল মিয়া লিবিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে অবস্থানকালে ইতালি পাঠানোর কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় এই তিন যুবককে। তাদের লিবিয়ায় থাকা মাফিয়া চক্রের মূল হোতাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মাফিয়া চক্রের হাত থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন শান্ত ও হারুন। এছাড়া শাকিল ধরা পড়ে যান তাদের হাতে। দুমাস নির্যাতন শেষে অতিরিক্ত ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্তি মিলে তার। তবে, মুকুল ঠাকুরের কাছে পাসপোর্ট থাকায় দেশে ফিরতে বাঁধা হয়ে উঠেছে।  

সরেজমিনে শান্ত ফকিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙাচোরা টিনের চৌচালা ঘরে বসবাস তাদের। বাড়িতে গেলেই তার মা-বাবা, পাড়া প্রতিবেশী আহাজারি শুরু করেন।  

এ সময় তার বাবা অহিদ ফকির কান্নাজড়িতে কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলেকে ইতালির প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে যায় মুকুল ঠাকুর। ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে আমার ছেলেকে আটকিয়ে ১৯ লাখ টাকায় আদায় করেছে। তবে, আজও ইতালি পাঠায়নি। আমি ধার-দেনা, সুদের ওপর ও জমি বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেছি। তারপর আবারও ১০ লাখ টাকা দাবি করছেন মুকুল ঠাকুর। আমি গরিব মানুষ এতো টাকা দেব কীভাবে? টাকা না দেওয়ায় তার ভাই আকরাম ঠাকুর আমাকে ভয়ভীতি ও হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি সালথা থানায় মামলা করতে যাই। কিন্তু মামলা না নিয়ে আমাকে আদালতে মামলা করতে পরামর্শ দেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। পরে আমি মানবপাচার আইনে আদালতে মামলা করি।  

তিনি আরও বলেন, আমি টাকা না দেওয়ায় এবং মামলা করায় গ্রামে থাকা তার ভাই ও আত্মীয়-স্বজন আমাকে ভয়ভীতিসহ হুমকি-ধামকি দেখাচ্ছেন। আবার শুনতে পাচ্ছি- ‘উল্টো আমরা মাফিয়া চক্র হয়ে গেছি, আমাদের নামেও আদালতে মামলা করেছেন নাকি তারা। ’ এই যদি হয় অবস্থায় তবে আমরা এখন যাব কোথায়।

এদিকে শান্তদের বাড়ির অদূরে হারুনদের বাড়ি। ওই বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। তাদের বাড়িঘরও জরাজীর্ণ অবস্থা। অহিদ ফকিরের মতো একই অভিযোগ করেন হারুনের বৃদ্ধ বাবা লাল মিয়া ফকির ও পাড়া প্রতিবেশী।  

লাল মিয়া ফকির বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে কিছুই হলো না। ওই দেশে না খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমার ছেলে। এখন আবার আমার ছেলে ও আমার নামে উল্টো মামলা করেছে দালাল চক্র। ভয়ে বাড়িতেও থাকতে পারতেছি না। ’ এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন হারুনের স্ত্রী রেশমা বেগম। ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে তার।  

মাফিয়া চক্রের করা মামলাটি করেন মুকুল ঠাকুরের স্ত্রী নাসিমা বেগম। তিনি ফরিদপুর মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আদালতে মানবপাচার আইন ২০১২ এর ৩/৬/৯/১০ ধারায় মামলাটি করেন। তাতে আসামি করা হয়, অহিদ ফকির ও তার ছেলে শান্ত ফকির, লাল মিয়া ফকির ও তার ছেলে হারুন ফকির এবং মুছা ফকির নামে এক ব্যক্তিকে।

মামলায় নাসিমা বেগম উল্লেখ করেন, তার স্বামী একজন নিরীহ মানুষ। দীর্ঘদিন লিবিয়া থেকে ২০২২ সালে ছুটিতে দেশে আসেন। পরে আসামিরা লিবিয়ায় উচ্চ চাকরির প্রলোভন দেখাতে থাকেন। পরে ওই বছরের ২৫ জুন আবার লিবিয়ায় চলে যান। পরে হারুন ও শান্ত লিবিয়ায় গিয়ে আমার স্বামীকে অজ্ঞাতনামা চক্রের হাতে বিক্রি করে দেন। এরপর আমার স্বামীকে নির্যাতন করে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে।  

বিষয়টি জানতে সরেজমিনে যাওয়া হয় ওই এলাকায়।  

গত শুক্রবার (৫ জুলাই) রামকান্তপুর বাজারে আয়ূব আলী নামে এক ব্যক্তির চায়ের দোকানে বসে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলাকালীন উঠে আসে মুকুল ঠাকুরের ভয়ংকর চিত্র। এলাকায় তিনি দালাল মুকুল নামে বেশ পরিচিত। ভুক্তভোগীদের নামে মুকুল ঠাকুরের স্ত্রীর করা মামলার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এ সময় নজরুল বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘মুকুল ঠাকুর লিবিয়ায় আজ ১৫-২০ বছর ধরে আছেন। তিনিইতো বড় দালাল, লিবিয়ায় আদম ব্যবসার মূলহোতাই তো তিনি। সেইতো ওগো লিবিয়ায় নিছে। ওরা মুকুল ঠাকুরকে লিবিয়ায় নিয়ে বিক্রি করবে কেন। ওরা গেছেইতো সেদিন। ’

বিষয়টি নিয়ে জানতে ওই বাজারের পাশে মুকুল ঠাকুরের বাড়িতে যাওয়া হয়। বাড়িতে ঢুকতে চোখে পড়ে মুকুল ঠাকুরের একতলা বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ভবনের। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরটি তালাবদ্ধ রয়েছে। এ সময় কয়েকজন নারী এগিয়ে এলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। মামলার বাদী নাসিমা বেগমকেও পাওয়া যায়নি।  

সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের করা পৃথক দুটি মামলা ও নাসিমা বেগমের মামলার তদন্তের (এফআইআর) দায়িত্ব দেওয়া সালথা থানা পুলিশকে। ইতোমধ্যে মামলাগুলোর বিষয়ে তদন্তে এক পুলিশ কর্মকর্তাও ওই এলাকায় গিয়েছেন। এতে আরও আতঙ্ক বেড়ে গেছে ভুক্তভোগীদের।

এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (সালথা-নগরকান্দা সার্কেল) মো. আসাদুজ্জামান শাকিল বলেন, মামলা তিনটির বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, মুকুল ঠাকুরের মাধ্যমেই এই দুই যুবক লিবিয়ায় গেছেন। তারা লিবিয়া গিয়ে একই চক্রের হাতে পড়েছে কিনা সেটি তদন্ত করে দেখা হবে। তবে, আমরা মামলাগুলো সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করব, যাতে করে কেউ হয়রানির শিকার না হন এবং তদন্তে যেটি আসবে সেই অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০২৪
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।