ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সেকালের চিঠি গিললো একালের স্মার্টফোন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০২৪
সেকালের চিঠি গিললো একালের স্মার্টফোন

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের জকসিন পোস্ট অফিসের অস্থায়ী অফিসের সামনে ঝুলানো একটি চিঠির বাক্স। পরিত্যক্ত এ বাক্সটি শুধু ঝুলানোই আছে, সেটির ব্যবহার নেই।

 

ঠিক কত বছর আগে এ বাক্সে চিঠি পড়েছে, তার হয়তো সঠিক তথ্য খুঁজেও পাওয়া যাবে না৷ কারণ এখন আর ডাকবিভাগ বা পোস্ট অফিসের সামনে ঝুলিয়ে রাখা চিঠিপত্রের বাক্সে চিঠি পড়ে না। কিন্তু ৯০ দশকের দিকেও এ বাক্সের যথেষ্ট কদর ছিল। এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা এ বাক্সের কদর কারো কাছে নেই।  

এক সময় দূর থেকে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল হাতে লেখা চিঠিপত্র। দূরে থাকা প্রিয়জন, আপনজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তথ্য এবং মনের ভাব আদান-প্রদান হতো কাগজে লেখা চিঠির মাধ্যমে। যার হাতের লেখা যত সুন্দর, চিঠির সৌন্দর্য তত বেশি। রং বে-রঙের কলম দিয়ে চিঠি লেখা হতো আপনজনদের উদ্দেশে। হতো পত্রমিতালী।  

পোস্ট অফিসে বা ডাকবিভাগের বাক্সে রাখা হতো চিঠি। পোস্ট মাস্টার, রানার বা ডাকপিয়নের হাত হয়ে সে চিঠি পৌঁছে যেত কাঙ্ক্ষিত মানুষের হাতে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হতো প্রিয়জনদের চিঠির প্রত্যাশায়। গ্রামের লোকজন পথ চেয়ে থাকতো খাকি পোশাক পরা ডাকপিয়নের।  

দীর্ঘ অপেক্ষার পর ডাকপিয়নের দিয়ে যাওয়া চিঠি হাতে পেয়ে কেউ উল্লাসে মেতে উঠতো, আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রিয়জনদের কাছ থেকে কোনো চিঠি না এলে মনে অজানা ভয় কাজ করতো। কাঙ্ক্ষিত চিঠি খুলে কেউ কাঁদতো, আবার কেউ আনন্দে আত্মহারা হতো।

সেই চিঠির প্রচলন এখন আর নেই। চিঠির সুখদুঃখ মাখা কাহিনিগুলো এখন যেন শুধু একটা গল্প। ৯০ দশকের আগের লোকেরা চিঠিপত্রের সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও এখনকার প্রজন্ম পরিচিত মোবাইল ফোনের সঙ্গে। সঙ্গে আছে স্মার্ট আরও নানা ধরনের ডিভাইস। তাই এ যুগে যেন চিঠির কোনো মূল্যই নেই। সেকেন্ডের মধ্যেই হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে।  

ইন্টারনেট আর যান্ত্রিক যোগাযোগের উন্নতির ফলে হারিয়ে গেছে চিঠি।  

ফলে চিঠি নিয়ে আর ব্যস্ততা নেই ডাক অফিসগুলোতে। নেই ডাক পিয়ন বা ডাক বাক্সের কদর।  

সাধারণত ডাক বিভাগের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়। যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাতে হাতে চিঠি বিলি করেন, তাদের বলা হয় ডাকপিয়ন। আর যারা এক অফিস থেকে অন্য অফিসে চিঠিগুলো পৌঁছে দেন, তারা হলেন রানার। পোস্ট অফিসে বসে যারা অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বলা হয় পোস্ট মাস্টার।  

চিঠি আদান-প্রদান নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা রয়েছে ডাক বিভাগে কর্মরতদের। কিন্তু এখন আর কোনো ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয় না বললেই চলে। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতের কিছু চিঠিপত্র এখনো ডাকে পাঠানো হয়।  

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার পোস্ট অফিসের ডাক পিয়ন মো. তছলিম। ১৯৮৫ সালের দিকে ডাক বিভাগে চাকরি শুরু করেন তিনি। এখন প্রায় শেষ সময়ে এসে ঠেকেছে কর্মজীবন। তবে যখন ডাক বিভাগে চিঠি বিলির চাকরি শুরু হয় তার, তখন থেকে চিঠি নিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। ডাক পিয়নরাই কারো দুঃখের খবরের ফেরিওয়ালা ছিল, আবার কারো জন্য আনন্দের খবরের বাহক ছিল।  

তিনি বলেন, দূর দেশে থাকা কোনো চাকরিজীবী বা প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন বা আপনজন তীর্থের কাকের মতো ডাকপিয়নের পথ চেয়ে বসে থাকতো। কেউ কেউ আবার দুদিন পর পর পোস্ট অফিসে এসে চিঠি এলো কি না খবর নিয়ে যেত।  

কোনো এলাকায় গেলে লোকজন জিজ্ঞেস করতো, আমার কোনো চিঠি আছে? উত্তর হ্যাঁ হলে চোখে-মুখে হাসি লক্ষ্য করতাম, আর চিঠি না থাকলে মন খারাপ করতো, যোগ করেন তিনি।  

তিনি বলেন, দূর দেশ বা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শুধু চিঠিই আসতো না, সঙ্গে টাকাও আসতো। সেগুলো আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিতাম। এতে বকশিশও পাওয়া যেত।

এক সময় এমনও হয়েছে, দিনে শতাধিক বিদেশি চিঠি আমার হাতে আসতো। সেগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছানোকে গুরু দায়িত্ব হিসেবে দেখেছি। যারা চিঠি পড়তে পারতো না, তাদের চিঠি পড়ে শুনিয়ে আসতাম। আবার কেউ কেউ আমার হাতে চিঠি লেখাতো। কিছু কিছু গোপন চিঠি ছিল, যেগুলো বিষয়ে প্রাপক ছাড়া অন্য কাউকে জানাতে নিষেধাজ্ঞাও থাকতো, বললেন এ ডাকপিয়ন।  

চিঠির সেই যৌবনকাল এখন আর নেই জানিয়ে এ ডাকপিয়ন বলেন, এখন তো কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। চিঠি লিখবে এমনটা চিন্তাও করে না। সর্বশেষ কবে ব্যক্তিগত চিঠি বিলি করেছি, তা মনেও নেই। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র না থাকায় আমাদের এখন আর আগের মতো ব্যস্ততাও নেই। এমনও দিন ছিল, সারাদিন চিঠি বিলির কাজ করতে করতে সময় পার হয়ে গেছে, খাবারের সময়ও পাইনি।  

আপনজনের চিঠির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কেউ অধৈর্য হয়ে যেতেন জানিয়ে এ তিনি নিজের পরিবারের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।  

বলেন, আমার বড় ভাই মো. সিরাজ উল্যা পাকিস্তানের করাচিতে চাকরি করতেন। ১৯৯২ সালের কথা। তিনি আমার মায়ের কাছে চিঠি লিখতেন। মাঝখানে তিন মাস পার হয়ে গেল, ভাইয়ের কোনো চিঠি আসেনি। আমার মা ফুলবানু বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাইয়ের চিন্তায় তিনি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলেন৷ তখন আমি নিজেই আমার ভাইয়ের নাম দিয়ে কাগজে একটি চিঠি লিখি। সেই চিঠি আমার মাকে পড়ে শোনাই। তখন আমার মায়ের বুক কিছুটা হালকা হয়।  

চিঠি নিয়ে এমন সুখদুঃখের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। ৯০ দশকের দিকে জোহরা নামে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের এক নারীর স্বামী মালয়েশিয়া থাকতেন। চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ হতো তাদের। কিন্তু হঠাৎ স্বামীর কাছ থেকে একেবারে বন্ধ হয় চিঠি পাঠানো। তবে এখান থেকে মালয়েশিয়ায় নিয়মিত চিঠি পাঠাতেন ওই নারী। কিন্তু কোনো উত্তর আসতো না। এভাবে কেটে যায় দুই বছর। পরে জানা গেল, ওই প্রবাসী কোনো কারণে সে দেশের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ফলে সেখান থেকে স্বজনদের কাছে চিঠি লেখার সুযোগ পাননি।  

এখন চিঠি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এর পরিবর্তে এখন জায়গা করে নিয়েছে ফেসবুক, মেইল, মেসেঞ্জার, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালসহ বিভিন্ন অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার সাব পোস্ট অফিসের সাব পোস্ট মাস্টার মো. হারুনুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৯৮ সালের দিকে পোস্ট অফিসের চাকরিতে যোগ দিই। শুরুতে প্রচুর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আসতো। দেশি-বিদেশি চিঠিগুলো বিলি করতে হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু ২০০৫ সালের পরে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র তেমন একটা আসেনি। লোকজনের হাতে যখন মোবাইল ফোন চলে আসে, তখন চিঠিপত্রের প্রচলন হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ তখন ই-মেইলের মাধ্যমে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। বিদেশি একটি চিঠির জবাব পেতে যেখানে এক মাসের বেশি সময় লাগতো, সেখানে এখন মুহূর্তেই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ভার্চ্যুয়ালি দেখা করতে পারে।  

লক্ষ্মীপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার মো. কামাল হোসেন বলেন, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তিগত চিঠি লেনদেন হয়তো কমে গেছে। তবে ডাক বিভাগের অন্যান্য কার্যক্রম কোনো অংশেই কমেনি।

৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। উপমহাদেশে প্রথম ডাক সার্ভিস চালু করা হয় ১৭৭৪ সালে।  

চিঠিপত্র ছাড়াও বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পারসেল বা মালামাল পরিবহন, আর্থিক সেবা অর্থাৎ মানি অর্ডার, বীমা পরিষেবা, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, প্রাইজবন্ড, নন পোস্টাল স্ট্যাম্প বিক্রি, ইলেকট্রনিক মানি অর্ডারসহ ডিজিটাল সেবা দিয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন পিছিয়ে আছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২৪
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।