ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত কয়েক হাজার পরিবার

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২৪
অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত কয়েক হাজার পরিবার

ঠাকুরগাঁও: গ্রামের সবাই খায়রুন সুন্দরী নামে ডাকেন উম্মে হুমাইরা সাইমাকে। এখনও চার বছর পূর্ণ হয়নি তার।

বয়সে পূর্ণ না হলেও স্বজন হারানোর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ সাইমা।  

বাবা শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে মারা গেছেন। কিছুদিন পরে অন্যত্র বিয়ে করেছেন তার মা। বাবা, মা হারিয়ে এখন দাদির কাছে মানুষ হচ্ছে সাইমা।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ গ্রামে দাদা শাহার আলী ও দাদি সাহেরা খাতুনের কাছে বেড়ে উঠছে সাইমা। বাবা শফিকুল ইসলাম পেশায় ছিলেন অটো মেকানিক। সে আয়ে বেশ ভালোই চলতো সংসার। পরে অর্থের লোভে অনলাইন জুয়ার (ক্যাসিনো) ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন সব পুঁজি। সব হারিয়ে করেছেন পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ঋণ। ঋণের বোঝা সইতে না পেরে নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে মারা গেছেন তিনি।
ঠাকুরগাঁওয়ে এভাবেই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। অর্থের লোভে পড়ে আসক্ত হচ্ছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, দোকানি, শিক্ষার্থী ও তরুণেরা। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন তাদের অনেকে। এতে বেড়েছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ।  

এ সুযোগে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন অনলাইন জুয়া চক্রের ডিলাররা। কামিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। চক্রের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে তরুণ ও যুব সমাজকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি এলাকাবাসীর।

ওইসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনলাইন জুয়ার ডিলারদের লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে সব হারাতে বসেছেন সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ, বোর্ড অফিস, সোনাহার, সেনপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ খেলায় যুক্ত হয়ে পথে বসেছে অনেক পরিবার।  

একাধিক ডিলারের তত্ত্বাবধানে এ নেশায় আকৃষ্ট হয়েছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। ফলে বেড়েছে পারিবারিক অশান্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ, কলহ। লেখাপড়া বিমুখ হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।  

অনলাইন জুয়ার ভয়াল এ গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাধারণ মানুষ।

তবে অনলাইন জুয়া খেলে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তারা জানান, একদিকে অনলাইন জুয়ার নেশায় সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হলেও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন জুয়া চক্রের ডিলাররা।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুয়াড়িদের অভিযোগ, আউলিয়াপুর ইউনিয়নের সেনপাড়ার একজন কয়েক বছর আগেও পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন। নিয়তির ঘুরপাকে অনলাইন জুয়ার ডিলার হয়ে পেয়েছেন আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ। দুই লাখ টাকার মোবাইল ফোন ও দামি ল্যাপটপ, চলাফেরা করেন চার লাখ টাকার মোটরসাইকেলে আর গ্রামে করেছেন পাকা বাড়ি। কিছুদিন আগেও যাদের নুন আন্তে পান্তা ফুরাতো তাদের এমন উত্থানে অবাক এলাকার মানুষ।

অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির খোঁজে তার বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রীর কাছে ফোন নম্বর চাইতে গেলে রেগে ওঠেন তিনি।  

তার অনলাইন জুয়া চক্রের অন্যতম ডিলার-এমন অভিযোগের ব্যাপারে তার মা দাবি করেন, আগে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে তার ছেলে যুক্ত থাকলেও এখন অনলাইন জুয়া খেলেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনলাইন জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িত একজন বলেন, অনলাইনে সহজেই এখন এ খেলাগুলো খেলা যায়। জুয়ার ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খেলার অ্যাকাউন্ট করতে হয়। পরে ডিলারের মাধ্যমেই টাকা তোলা যায় ও খেলায় টাকা লাগানো হয়। অনলাইন জুয়া খেলার অনেকগুলো সাইট আছে। অ্যাকাউন্ট করে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লাগাতে হয়। লাভ হলে আবার একই মাধ্যমে টাকা তুলতে হয়। তবে এ খেলায় যারা ডিলার তারাই লাভবান হন। সাধারণ যারা খেলেন, তারা প্রথমে লাভের লোভে পরে সর্বস্বান্ত হয়।

তবে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ও অভিযুক্তদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
  
জুয়া খেলে ও ডিলার ছিলেন এমন আরেকজন জানান, ডিলারদের কাছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সিম থাকে। সেই সিম থেকে টাকা লেনদেন হয়। প্রতিদিন এসব সিমে লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয়। এসব এজেন্ট সিম ভাড়া হিসেবে নিয়ে চালান জুয়ার ডিলাররা। টাকা লেনদেন হলে ডিলারের লাভ হয়। তবে সাধারণ জুয়াড়িরা লাভ করতে পারেন না। প্রথমে খেলায় লাভের লোভ দেখানো হয়। সেই লোভে পরেই জুয়াড়িরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর মোবাইল ফোন দিয়েই খেলতে হয়, তাই যে কোনো স্থান থেকেই খেলা যায়।

সদর উপজেলা বোর্ড অফিস এলাকার নুর ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার কম বেশি অনেকেই এ খেলার সঙ্গে জড়িত। সন্ধ্যার পর যেখানে সেখানে কয়েকজন বসে জুয়া খেলার আসর বসান। তবে তারা মোবাইল ফোনে খেলে বলে কেউ তাদের ধরতে পারেন না। এ এলাকার অনেকেই আজ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন জুয়া খেলে। প্রশাসনও তেমন পদক্ষেপ না নেওয়ায় দিন দিন জুয়া খেলা বাড়ছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।

ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম বলেন, মানুষকে সর্বগ্রাস করে ফেলে জুয়া। অনলাইন জুয়ার তেমন কোনো আইন নেই। সাধারণ জুয়ার আইনে তাদের আটক করতে হয়। সেজন্য অপরাধ অনেক বড় হলেও সহজেই পার পেয়ে যান অপরাধীরা। এছাড়া অনলাইন জুয়া খেলা হয় মোবাইল ফোনে। সেজন্য সহজে জুয়াড়িদের ধরাও যায় না। এ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২৪
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।