ঢাকা: র্যাব-২ ও র্যাব-১০ এর সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকীর বিচার দাবি করেছেন তার হাতে বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) ‘ক্রসফায়ারের কারিগর র্যাবের কসাই খ্যাত মহিউদ্দিন ফারুকীর ফাঁসি চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান ভুক্তভোগীরা।
সংবাদ সম্মেলনে গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা বলেন, আমরা মহিউদ্দিন ফারুকীর বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই। লক্ষ্য রাখতে হবে তিনি যেন পালিয়ে যেতে না পারেন। র্যাবের কসাই নামে পরিচিত এ মহিউদ্দিন ফারুকীর জঘন্য অপরাধের বিচার না হলে দেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হবে।
তারা আরও জানান, মানবতাবিরোধীর অপরাধে মহিউদ্দিন ফারুকী বর্তমানে গ্রেপ্তার আছেন।
সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন কৃষিবিদ ফসিউল আলম।
তিনি বলেন, উত্তরায় আমার অফিস থেকে বের হলে আমাকে মহিউদ্দিন ফারুকী আটক করে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যান। পরে রাত ১০-১১টার দিকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ‘তুই কেন সরকারের বিরুদ্ধে লিখস?’ তারপরে আমাকে ছোট একটি কক্ষে গুম করে রাখা হয়।
নির্যাতনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেখানে আমাকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। শক দেওয়ার কারণে আমার ব্রেনের সামনে অংশ শুকিয়ে গেছে। আমার হাতের ওপর বুট পরে লাফিয়েছে। আমি হাত দিয়ে কিছু খেতে পারতাম না। আমাকে না পেয়ে আমার বৃদ্ধ বাবা রাস্তায় রাস্তায় খুঁজেছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা জানি না গুমের শাস্তি কি? আমরা চাই গুমের শাস্তি ফাঁসি হোক। আমরা মহিউদ্দিন ফারুকীর ফাঁসি চাই।
ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হুমায়ূন কবির ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর একটি মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে লঞ্চ থেকে তাকে ধরে নিয়ে গুম করা হয়। তিনি বলেন, আমি ব্লগে সরকার বিরোধী লেখালেখি করতাম। কিন্তু রাষ্ট্র বিরোধী কোনো লেখালেখি করিনি। একটি মামলার হাজিরা দেওয়ার সময় লঞ্চ থেকে কয়েকজন লোক আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। তাদের দুইজন পিস্তল ধরা ছিল, আরেকজন আমার কোমরের বেল্ট ধরেছিল। তারা একটা গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে একটি রুমে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। সেখানে একজন আমাকে চা অফার করে। কিন্তু আমি সেটা খেতে চাইনি। পরে তারাও অনুরোধ করে যে আপনি চা খেলে আমরাও চা খেতে পারব। চা খেতে রাজি হওয়ার পর একজন বলেন, এই ওরে লাল চা দে। এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখের চাপা বরাবর লাথি মারে। এতে আমি চোখ বাঁধা অবস্থায় চেয়ারসহ পরে যাই। আমার একটি চাপার দাঁত ভেঙে যায়। তারপর আমাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। আমার এক কানে কারেন্টের শক দেওয়া হয়। ফলে আমি একটি কানে এখনও শুনতে পাই না। এর অনেকদিন পরে ৬ তারিখ মেবি, আমাকে একটি জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে অনেক বাস কাউন্টার ছিল। ছেড়ে যাওয়ার পরপরই একটি গাড়িতে আমি মহিউদ্দিন ফারুকীকে দেখি। ওই গাড়িতে র্যাব-১০ লেখা ছিল। তখন বুঝতে পারি আমাকে র্যাব গুম করে রেখেছিল। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর তখন অনেকে ফলো করছিল। এরপর আমি একটু জোরে হাঁটার চেষ্টা করি। তখন তারা এসে বলে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপর আমাকে বলা হয় এতদিন যা হয়েছে, সব ভুলে যান। আপনাকে আজকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারপর আমাকে আবারও রিমান্ডে নেওয়া হয়। আমি এখন পর্যন্ত ২০৮ বার হাজিরা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা এখন মহিউদ্দিন ফারুকীর বিরুদ্ধে গুম কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা করেছি। মহিউদ্দিন ফারুকী আমার কাছে থেকে তখন চার লাখ টাকা নিয়েছে, ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়েছেন। বাসা থেকে আরও টাকা নিয়েছেন।
খালেদা জিয়াকে নিয়ে বই প্রকাশ করার জন্য দুই দফায় গুমের শিকার হন শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাজন ব্যাপারী। তিনি বলেন, আমাকে অনেক অত্যাচার করা হয়েছে। অনেকবার ক্রসফায়ারের জন্য নেওয়া হয়েছে। আমাকে কনডেম সেলে আটকে রাখা হতো। কীভাবে দিন গিয়েছে বলতে পারতাম না। ফজরের আজানে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ শুনলে বুঝতাম আমার আরেকটা দিন গিয়েছে। কবে আমাদের মেরে ফেলা হবে, কোথায় লাশ পাওয়া যাবে কেউ চিনবে কিনা জানি না। এ কারণে আমরা আমাদের পরনের গেঞ্জি-ট্রাউজারের নিচে বাসার কারও ফোন নাম্বার আর আমার নাম লিখে রাখতাম। যাতে আমাদের লাশ তাদের কাছে পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন গুমের শিকার রেজওয়ানুল হক শোভন, ড. এনামুল হক মনি, আ আ জাবীদ প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২৪
এসসি/আরআইএস