ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সার বিতরণে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ বিএডিসির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
সার বিতরণে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ বিএডিসির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে

দিনাজপুর: অল্প সময়েই নীতিমালা ভঙ্গ করে ডিলারদের হয়রানি, সার বিতরণে ঘুষসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দিনাজপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক (সার) শওকত আলীর বিরুদ্ধে।  

অভিযোগ, সার উত্তোলনের সময় স্বাক্ষরের নামে ডিলারদের বিভিন্নভাবে হয়রানি, দুর্বল শ্রেণির ডিলারদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে উৎকোচ আদায়, প্রতিবার সার উত্তোলনের সময় প্রকারভেদে প্রতি স্যারের বস্তায় ৬০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি টাকা আদায়, সার গুদামের সীমানা প্রাচীর নির্মাণে অনিয়ম করে যাচ্ছেন শওকত আলী।

 

জানা গেছে, প্রতি বস্তায় ৫০ টাকা করে উৎকোচ আদায় করা হলেও বরাদ্দকৃত সারের বস্তা থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত টাকা আদায় হবে। বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে শওকত আলী এ ধরনের বেপরোয়া কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ ডিলারদের।

এছাড়া কার্যালয়েই আলাদা কক্ষ বানিয়ে তাতে আসবাবপত্র রেখে রেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে বিএডিসির এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

কার্যালয়ে শওকত আলীর রেস্টরুম

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শওকত আলী।  

এদিকে গত ২ নভেম্বর বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও এখন পর্যন্ত সুরাহা না পেয়ে হতাশ ভুক্তভোগী ডিলাররা।  

লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সার উত্তোলনের দরখাস্তে সহকারী পরিচালকের (এডি) স্বাক্ষরের দায়িত্ব থাকলেও যুগ্ম পরিচালক স্বাক্ষরের নামে ডিলারদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে থাকেন। দুর্বল শ্রেণির ডিলারদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে উৎকোচ আদায় করেন। সার উত্তোলনের সময় টাকা না দিলে নিকটবর্তী গুদামে সার থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী গুদামে সার নিতে বাধ্য করেন। প্রতিবার সার উত্তোলনের সময় তাদের কাছ থেকে বস্তাপ্রতি তিউনেশিয়া টিএসপি সারের জন্য ৮০ থেকে ১০০, চায়না ডিএপি সারে ৬০ থেকে ৮০ এবং কানাডা এমওপি সারের জন্য ২০ টাকা করে বাধ্যতামূলকভাবে নেওয়া হয়। না হলে চাহিদামতো সার দেওয়া হয় না। তার নির্দেশনায় সার রিকাউন্টিংয়ের কোটেশন ও ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সার আনলোডের সময় লেবারদের কাছ থেকে জোরপূর্বক উৎকোচ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।  

এছাড়াও পার্বতীপুরে সারগুদাম নির্মাণে অনিয়মের কথা উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ উল্লেখ করা হয়।  

দিনাজপুর সদর উপজেলার ৪নং শেখপুরা ইউনিয়নের ডিলার আব্দুল বাতেন বলেন, আমি যদি সার উত্তোলনের জন্য আবেদন করি তাহলে আমাকে নিয়ম অনুযায়ী নশিপুর গোডাউন থেকে সার দেওয়া হবে। কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে বিরামপুর থেকে। আমি তো তাকে অন্যান্যদের মতো সন্তুষ্ট করতে পারিনি। টাকা দিলে তিনি সবকিছু ম্যানেজ করে দেন আর না দিলে তিনি বিপাকে ফেলেন। আবেদন করলেও ঠিক সময়ে সার পাই না। কৃষকদেরকে তখন সার দিতে দেরি হয়। আমি চাই এই বিষয়টির সুরাহা হোক।  

একইরকম অভিযোগের কথা জানালেন জেলার হাকিমপুর উপজেলার সার ও বীজের ডিলার আহসান হাবীব।  

তিনি বলেন, যুগ্ম পরিচালককে অনারিয়াম দিলে তাড়াতাড়ি সুবিধামতো গুদাম থেকে সার পাওয়া যায়। আর দিতে অস্বীকার করলে নিকটবর্তী গুদামে সার থাকা সত্ত্বেও দূরে পাঠিয়ে দেন। এতে আমাদের পরিবহন খরচটা বেড়ে যায়। কেউ প্রতিবাদ করলে তিনি ডিলারদের গালিগালাজ করেন। আমাদের পক্ষ থেকে বিএডিসির চেয়ারম্যান বরাবর যে অভিযোগ দেওয়া আছে আমরা তা তদন্ত করে সঠিক বিচার চাই।  

উৎকোচ নেওয়া বাদ যায়নি গাড়িতে সার লোড-আনলোড করা শ্রমিকদের থেকেও। কথা হলে পুলহাট গোডাউনের শ্রমিক সরদার করিমুল হক বাচ্চু বলেন, আগে যখন কয়েকবার টাকা দিয়েছি তখন আমার গোডাউনে সার রাখা হতো। সেগুলো লোড-আনলোড করে আমরা টাকা পেতাম। এবার আমি টাকা দিইনি। নভেম্বর মাসেও আমার গোডাউনে কোনো সার রাখা হয়নি। প্রতি টনে তাকে ৫ টাকা করে দিতে হতো। তাহলে সব ঠিক চলতো। এবার টাকা না দেওয়ায় আমার অধীনে থাকা ২৫ জন শ্রমিক নভেম্বর মাস থেকে কাজবিহীন অবস্থায় আছে।

অভিযোগকারী বিএডিসি বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মির্জা লিয়াকত আলী বেগ বলেন, আমাদের ডিলার সদস্যরা বর্তমান যুগ্ম পরিচালকের বিরুদ্ধে উৎকোচ নিয়ে তা বিতরণের অভিযোগ তুলেছেন। লেবার, স্টোর কিপার থেকে শুরু করে ডিলার সবারই উনাকে (শওকত আলী) টাকা দিতে হয়। গত ২ নভেম্বর বিএডিসির চেয়ারম্যান বরাবর আমরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তিনি ঢাকায় গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।  

এদিকে গুদাম থেকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সার উত্তোলন করায় বাড়তি খরচের প্রভাব পড়েছে কৃষক পর্যায়ে। অধিকাংশ রিটেইলার দোকানে সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে না এসব সার। এত বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা।  

দিনাজপুর সদর উপজেলার গৌরীপুর এলাকার কৃষক মোখলেছার রহমান বলেন, বর্তমানে তো সারের সংকট দেখা দিয়েছে। বিডিসির সার পাওয়া কষ্টকর হয়ে গেছে। তাই বিভিন্ন কোম্পানির সার কিনতে হচ্ছে। এতেও আমাদের সমস্যা হচ্ছে। যেখানে তিনবার সার প্রয়োগ করতে হতো এখন পাঁচবার করতে হয়। আমরা যদি সুলভমূল্যে সার পেতাম তাহলে আমাদের জন্য ভালো হতো।  

সদর উপজেলার ঘুঘু ডাঙ্গা পশ্চিমপাড়া এলাকার আরেক কৃষক ছালেহুর রহমান বলেন, বিএডিসি ডিলারদের কাছে গেলে তো সার পাওয়া যাচ্ছে না। আর দিলেও একসঙ্গে চার ধরনের সার নিতে হচ্ছে। সব সময়তো আর সব ধরনের সার কাজে লাগে না। তখন বাধ্য হয়ে অন্য সাধারণ দোকান থেকে সার কিনতে হয়। তখন আবার বস্তাপ্রতি দুই থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হচ্ছে। এতে করে আমাদের উৎপাদন খরচটা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা চাই সরকারের দেওয়া মূল্যে যেন কৃষক পর্যায়ে সারটা ঠিকমতো পৌঁছায়। তাহলে আমরা কৃষকেরা উপকৃত হব।  

সদর উপজেলার গৌরীপুর এলাকার সারের রিটেইলার ফরিদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমাদেরকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। যার প্রভাব কৃষকের ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। সরকারি মূল্য অনুযায়ী এক বস্তা টিএসপি এক হাজার ৩৫০ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকা পর্যন্ত। পটাশ সার এক হাজারের পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৪০ টাকা। আর ডেব সার এক হাজার টাকার পরিবর্তে এক হাজার ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।  

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সরেজমিনে যুগ্ম পরিচালক শওকত আলীর কার্যালয়ে যাওয়া হয়। কার্যালয়ে তার কক্ষের পাশেই যে রেস্টরুমের অভিযোগ রয়েছে তার সত্যতা মেলে। ওই রুমে সোফাসেট রয়েছে। ডাবল সিটের খাটও রয়েছে সেখানে, সঙ্গে অ্যাটাচ বাথরুম। অথচ তার রুমের পাশে আরও একটি বাথরুম রয়েছে।  

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম-পরিচালক শওকত আলী বলেন, প্রতিটা অফিসে এ ধরনের রুমের ব্যবস্থা থাকে। এখানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে রেস্ট নেওয়ার পাশাপাশি নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকে। তাই এই রুমটা তৈরি করা হয়েছে।  

এমন রুম তৈরির ব্যাপারে অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রুম তৈরির অনুমোদন নাই। তবে ছাদ মেরামতের জন্য বরাদ্দ ছিল। সকলের সুবিধার জন্য এ ধরনের রুম তৈরি করা হয়েছে।  

টাকা ছাড়া সার উত্তোলনের ছাড়পত্র না দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা নেওয়ার অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি প্রমাণ করতে পারলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। আমি এখানকার ডিলারদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছি। তাই কয়েকজন ডিলার আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করছেন।  

টাকা নিচ্ছেন এমন একটি ভিডিওর ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এটা বস্তা প্রতি টাকা নয়, শ্রমিকদের আনলোড করার টাকা। আমি কখনো কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি।  

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দিনাজপুর অঞ্চলের যুগ্ম-পরিচালক (সার) পদে যোগদান করেন শওকত আলী।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।