নাটোর: আজকাল শিরনি উৎসব সচরাচর আর চোখে পড়ে না। তবে শিরনি উৎসবের ঐতিহ্য রয়েছে দীর্ঘদিনের।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) দিনব্যাপী এ গ্রামের ২৬টি সমাজের ৪৬০টি পরিবার মিলে এই গাঁওয়ালী শিরনি উৎসবের আয়োজন করেন।
প্রতিটি বাড়ি থেকে নগদ ২০০ টাকা ও ৫০০ গ্রাম চাল সংগ্রহ করে আজ ভোর থেকে সকলের সম্মিলিত আয়োজনে রান্না-বান্না শুরু করা হয়।
দুপুর হতে না হতেই শুরু হয় একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। এতে দূর-দূরান্ত থেকে ওই গ্রামের জামাই-মেয়ে-নাতি-নাতনীসহ স্বজনসহ প্রায় দুই হাজার মানুষ এই শিরনি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
একসঙ্গে রান্না, খাওয়া-দাওয়া আর উচ্ছাস-আনন্দে ধনী-গরিব এবং রাজনৈতিক ভেদা ভেদ ভুলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মিলে পালন করলেন তাদের পূর্ব-পুরুষের রেখে যাওয়া গাঁওয়ালী শিরনি উৎসব। পাশাপাশি বসানো হয় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে বিনা পয়সায় গ্রামের দরিদ্র মানুষরা চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন।
এই উৎসবে অংশ নিয়ে আজ গ্রামবাসীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। সঙ্গে ছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বাচ্চু,সাবেক সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীন, দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, আবুল কাশেম গেদু ও আবুল কাশেমসহ নেতারা।
এসময় বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল। আগামীতে ক্ষমতায় গেলে আমরা সেই ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। সমাজে সবাই সমান ভাবে বাঁচতে পারবে। সমান অধিকার বাস্তবায়ন করা হবে। যার যার ধর্ম সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে ভাতুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. সেলিম উদ্দিন জানান, এই শিরনি উৎসব পালন করতে প্রতিটি বাড়ি থেকে নগদ টাকা ও চাল সংগ্রহ করে একত্রিত করা হয়। এরপর সেগুলো রান্না-বান্না করে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা হয়।
তিনি বলেন, এই গ্রামে ২৬টি সমাজ রয়েছে। প্রতিটি সমাজের একই দিনে এই শিরনির জন্য ভাগপ্রতি নগদ ২শ টাকা এবং ৫শ গ্রাম চাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে উৎসবে অংশ নেন গ্রামবাসী। পরিবারের সদস্য ও আগত আত্মীয়দের সংখ্যা ভেদে ৮ থেকে ১০টি পর্যন্ত ভাগ দেন পরিবার প্রধান। সমাজের সব টাকা ও চাল উত্তোলন শেষে একই দিনে আয়োজন করা হয় এই গাঁওয়ালী শিরনি উৎসব।
স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. নাদিম মাহমুদ জানান, প্রায় ২শ বছর আগে পূর্বপুরুষরা এই শিরনি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে আজও উৎসব চলমান আছে। কথিত আছে, এই গ্রামে এক সময় ডায়রিয়া-কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেসময় নাকি অনেক মানুষও মারা যান। তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। তাই এই রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে সেই সময় আতাব্দি ফকির নামে এক আলেম এই শিরনি করার পরামর্শ দেন। তার কথা মত গ্রামবাসী মিলে শিরনির আয়োজন করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন ওই গ্রামবাসী। কিছুদিন পর একইভাবে গবাদি পশুও আক্রান্ত হলে একইভাবে শিরনি উৎসব পালন করা হয়। এরপর ওই প্রাদুর্ভাব থেকেও রক্ষা পান ওই গ্রাম। এরপর থেকেই এই উৎসব এখনও পালন করা হয়।
দিঘাপতিয়া পিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আনোয়ার জানান, প্রতিবছর ভাতুরিয়া গ্রামে দুইবার এই উৎসব পালন করা হয়।
প্রতি শীতকালে ঝাল শিরনি ও আষাঢ় মাসে (বর্ষাকালে) মিষ্টি শিরনির আয়োজন করা হয়। তারা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছেন। উৎসবে আগত আত্মীয় আর বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করা হয়। এতে গ্রামবাসীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়েছে। আর এই শিরনি উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে নানা খাবার আর খেলনা সামগ্রীর দোকান পসরা। বলা চলে, শিরনি উৎসবকে ঘিরে দিনব্যাপী চলে গ্রামীণ মেলা।
ওই গ্রামের তরুণ-তরুণীরা বলেন, ভাতুরিয়া গ্রামের গাঁওয়ালী শিরনি উৎসবে ঈদের চেয়েও আনন্দ হয় বেশি। সবাই মিলে একসঙ্গে আনন্দ করে এবং সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেন গ্রামবাসী।
দিঘাপতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে জানান, ছোট বেলা থেকেই তিনি এমন ধরনের শিরনি উৎসব দেখে আসছেন। প্রতিবছরই এই উৎসব পালন করা হয়। তাদের দেখাদেখি এখন আশেপাশের গ্রামগুলোতেও অনুরূপ গাঁওয়ালী শিরনির আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০২৫
এএটি