চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোবাইল আসক্তির কারণে এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে তিন নার্সের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত তিনজন নার্সকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
এ ঘটনায় শিশুটির বাবা থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করেছেন।
অভিযুক্তরা হলেন- সিনিয়র স্টাফ নার্স আম্বিয়া খাতুন, মজিদা খাতুন ও আমেনা খাতুন।
চিকিৎসার অবহেলায় মৃত্যু ১৬ মাস বয়সী শিশুটির নাম মো. আয়ান উদ্দিন। সে রহনপুর পৌর এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মুক্তাশা হলপাড়া মহল্লার আমিন ইসলামের সন্তান।
মৃত ওই শিশুর বাবা আমিন জানান, গত ৮ জানুয়ারি (বুধবার) বিকেলে পাতলা পায়খানাজনিত কারণে শিশুপুত্র আয়ানকে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার রাতে চিকিৎসাধীন ছেলের স্যালাইন শেষ হলে অভিযুক্তদের কাছে আর স্যালাইন লাগবে কিনা বা এখন কি করণীয় তা জানতে যান। এ সময় তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনবার তাদের কাছে যাওয়ার পরও তারা কর্ণপাত করেনি। এসময় দায়িত্বরত কোনো চিকিৎসককেও পাওয়া যায়নি।
আমিনের অভিযোগ যথাসময়ে স্যালাইন না দেওয়ার কারণে তার ছেলে শনিবার সকাল ৭টার দিকে মারা যায়। এ ঘটনায় তার স্বজনসহ এলাকাবাসী হাসপাতালে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় তারা অভিযুক্ত নার্সদের একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন। পরে পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক নেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ইসমাঈল হোসেন লিংকন দায়িত্বে অবহেলার কারণে অভিযুক্ত তিন নার্সকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে মৃত শিশুটির বাবা আমিন ইসলাম বাদী হয়ে গোমস্তাপুর থানায় অভিযুক্ত ওই তিন নার্সকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন।
সাবেক পৌর মেয়র ও বিএনপি নেতা মো. তারিক আহম্মেদ জানান, ফুটফুটে একটি শিশু সন্তান নার্সদের অবহেলায় মারা গেল যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। তাহলে আর কোনো নার্স মোবাইল ফেন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে না।
জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আসাদুল্লাহ আহম্মেদ জানান, জনগণের টাকায় তাদের বেতন হয়। অথচ সেবা বাদ দিয়ে তারা স্মার্ট ফোনে আসক্ত থাকবে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। জনগণ এ হাসপাতালের সেবা নিয়ে যেভাবে বিক্ষুব্ধ আমরা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে যেত। এ সময় তিনি হাসপাতালে ব্যাপক সংস্কারের দাবি জানান।
মৃত শিশুর মা ময়না বেগম বলেন, বিয়ের ১০ বছরের সাধনায় পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ডায়রিয়া হওয়ায় তাকে সুস্থ করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখন নার্সদের অবহেলার কারণে তাকে হারাতে হলো। সব হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। আমি অভিযুক্ত নার্সদের কঠোর শাস্তি চাই।
এরপর আর কিছুই বলতে পারলেন না মা ময়না বেগম। হাসপাতালের বারান্দায় সন্তানের মরদেহ সামনে রেখে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে পুরো হাসপাতাল জুড়ে চলছে উত্তেজনা। সকাল ৭টার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে হাসপাতালের স্টাফরা অভিযুক্তদের একটি ঘরে রেখে দরজা আগলে রাখে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাদের তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী এক রোগী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, পরপর বলার পরও হাসপাতালের কেউ কর্ণপাত না করায় এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলো। এখানকার কেউ চায় না হাসপাতালে কোনো রোগী চিকিৎসা নিক। একটু কিছু হলেও রোগীকে রেফার্ড করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা রমজান আলীর ভাষ্য হাসপাতালে যখনই আসা হয় তখনই নার্সরা কেউ খোস গল্পে আবার কেউ মোবাইলে আশস্ত থাকে। তাদের কাছে কোনো সাহায্য চাইতে গেলে তারা বিরক্ত হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুর রহমান জানান, বেলা ১০টার দিকে শিশু আয়ানের মৃত্যুর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতাল লোকে ভরে যায়। বিক্ষোভ আরম্ভ করে অনেকে। পরিস্থিতি বিগতিক দেখে পুলিশ তলব করা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একপর্যায়ে উপজেলা জামায়াত আমির, বিএনপির সাবেক উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়রসহ স্থানীয় নেতারা এসে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ দেন। একপর্যায়ে স্থানীয় নেতারা অভিযুক্তদের ব্যাপারে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানালে দুপুরে অভিযুক্ত তিন নার্সকে সাময়িক অব্যাহতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল আবাসিক অফিসার (আরএমও) জানান, বিষয়টি আমরা জেনেছি। যারা দায়িত্বে ছিল তাদের দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও জানান, তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একটি অফিস আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন এবং অভিযুক্তদের পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল ফোনে বা সরাসরি পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫
আরএ