ঢাকা: ২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর ৩০টি ঘটনার মধ্যে ২৭টি ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিদায়ী বছরে বিভিন্ন ধরনের চাঞ্চল্যকর অপরাধ ঘটেছে।
তিনি আরো বলেন, যেকোনো অপরাধ দমনে পুলিশ সর্বদাই প্রতিরোধী। এতে করে কোনো অপরাধীই রেহাই পাচ্ছে না। পুলিশের জালে আটকে পড়ছে তারা। ২০১৫ সালের ৩টি ঘটনা ছাড়া সংঘটিত সব চাঞ্চল্যকর অপরাধ উদঘাটিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে অপরাধ দমনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুরু হয় বছরের শুরুতে। সারাদেশে অবরোধের নামে পেট্রোল বোমা, আগুন জ্বালানো, পোড়ানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় একাধিক রাজনৈতিক দল। ঝরে পড়ে ১ জন পুলিশসহ ৮০ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ। ৯২ দিনের সেই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা থেকে এদেশের মানুষকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে মাঠে থেকেছে পুলিশ। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের নিরাপত্তা এবং শান্তি ফিরিয়ে আনে।
এর মধ্যে শুধু অগ্নিদগ্ধ হয়ে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮ জন নিরীহ মানুষ। ওই সময় গ্রেফতার করা হয় অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ও মামলার আসামি ৭ হাজার ৫’শ ৯৯ জন জনকে। কখনো পুলিশের হাতে, কখনো জনগণের হাতে ধরা পড়েছে তারা। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন তাদের কেউ কেউ।
বিদায়ী বছরে চাঞ্চল্যকর ৩০টি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুলিশ ২৭টি ঘটনা পুরোপুরি প্রতিরোধ এবং উদঘাটন করেছে। ৩টি ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে।
বছরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটা দেখিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত ২৩ ডিসেম্বর মিরপুরের শাহ আলী আবাসিক এলাকায় ডিবি এবং সোয়াটের পাঁচটি দল অভিযান চালায়। ১৬ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে জেএমবির তিন গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিসহ সাতজনকে আটক এবং ১৬টি অবিস্ফোরিত হ্যান্ড গ্রেনেড, দু’টি পাইপবোমা, ট্রাংক ভর্তি বিস্ফোরক, কয়েকটি সুইসাডাল ভেস্ট, পিস্তলের ১৬টি গুলি এবং লেদ মেশিনের সরঞ্জামসহ দুই শতাধিক বোমা তৈরির উপকরণ উদ্ধার করে। জঙ্গিদের বোমা হামলার মুখেও পুলিশ পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতা দেখিয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতার করেছে হতাহত না করেই।
গত ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আমিনবাজারে জঙ্গি আস্তানা থেকে স্নাইপার রাইফেল, সেনাবাহিনীর পোশাক, র্যাংক ব্যাজ, গুলি ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে জেএমবির তিন সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ।
এর পরদিন ২৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে গাজীপুরের ভোগরা বাইপাস এলাকায় র্যাব অভিযান চালাতে গেলে বোমা ছোঁড়ে জঙ্গিরা। সে সময় আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায় র্যাব। মারা যায় দু’জন জেএমবি সদস্য।
গত ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে মসজিদে বোমা হামলার ঘটনায় আটক হয়েছে দু’জন। এর আগে ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ জেএমবি’র বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। নিষিদ্ধ ঘোষিত ওই সংগঠনটির চট্টগ্রাম শাখার সামরিক কমান্ডার তৌফিকুল ইসলাম জাবেদসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে সময় ৯টি হ্যান্ডগ্রেনেড, একটি পিস্তল, ১২০ রাউন্ড গুলি, বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম উদ্ধার করে। কিস্তু নিজেদের বোমা ফাটিয়ে মারা যায় জাবেদ।
বছরের শুরুতে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রী নিলয়, অভিজিৎ রায় এবং প্রকাশক দীপনকে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। অনন্ত বিজয় খুনের ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তারা আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করেছেন। ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে তিনজনকে একটি পিস্তল ও দু’টি ছোরাসহ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারাও আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করেছেন।
অক্টোবর মাসে ঢাকার গুলশানে তাবেলা সিজার এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক হোসি কুনিওকে হত্যা করা হয়। ডিবি পুলিশ তাবেলা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। কথিত বড় ভাইয়ের নির্দেশে টাকার বিনিময়ে তারা ওই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালান বলে স্বীকার করেছে। সরকারকে চাপে ফেলে বিব্রত করা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক সেই বড়ভাই বিএনপি নেতা কমিশনার মো. কাইয়ুমের ছোটভাই আব্দুল মতিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রংপুরে হোসি কুনিও হত্যাকাণ্ডে জেএমবি সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। রংপুর জেলা পুলিশ একাধিক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত মাসুদ আদালতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
৫ অক্টোবর ঢাকায় খিজির খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৭ জন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে খিজির খানের দু’টি ল্যাপটপ এবং দু’টি ক্যামেরা উদ্ধার ও জব্দ করা হয়েছে। তারা গোপীবাগের লুৎফর রহমান হত্যার দায়ও স্বীকার করেছে।
৫ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে হত্যা চেষ্টার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও রক্তমাখা পোশাক। তাদের তিনজন আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন। তারা জেএমবি’র সদস্য।
২২ অক্টোবর রাজধানীর দারুসসালামে এএসআই ইব্রাহিমকে খুন করা হয়। খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হন মাসুদ রানা নামের জেএমবি সদস্য। তার কাছ থেকে পুলিশ ৫টি হ্যান্ড গ্রেনেডও উদ্ধার করেছে।
২৪ অক্টোবর হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় জেএমবির জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। আসামিদেরকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় ডিবি। মূল আসামি মাহফজুর রহমান ওরফে বাকী ওরফে আল বানী ওরফে শাহাদাত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আরো ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
৪ নভেম্বর ঢাকায় আশুলিয়ায় কনস্টেবল মুকুল হত্যাকাণ্ডটি পূর্বোক্ত দলই চালিয়েছিল বলে তদন্তে জানা যায়। এ দলের ৫ জনকে পিস্তল এবং গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়েছে।
রংপুরে খাদেম রহমত উল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনকে হত্যা চেষ্টায় গ্রেফতার হয়েছেন মাসুদ রানা, ইসহাক আলী, বাবর এবং লিটন মিয়া। তারা আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন।
৪ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোলে রাসমেলায় হামলায় জেএমবি সদস্যের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আটক হয়েছেন মোসাব্বির, আবু বকর ও মেহেদী হাসান। আটককৃতদের কাছ থেকে একটি একে ২২ এসএমজিসহ গুলি ও বোমা উদ্ধার করা হয়েছে।
২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারায় কাদিয়ানী মসজিদে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে বোমা হামলা চালিয়েছে। সেটা তদন্ত চলছে।
গত ২১ এপ্রিল ঢাকা জেলার আশুলিয়ায় ৮ জনকে খুন করে ব্যাংক ডাকাতি করে দূর্বৃত্তরা। ওই মামলায় ১১ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা জেএমবি’র সদস্য। তাদের ৬ জনই আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন।
গত সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের শাহ কর্পোরেশনে ডাকাতির ঘটনায় অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়েছেন ৫ জেএমবি সদস্য। তারা আদালতে এ ডাকাতি, চট্টগ্রামের ন্যাংটা ফকিরসহ দুই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন।
টাকার জন্য ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুর সদর থানায় তৃপ্তি ফিলিং স্টেশনে ডাকাতি করে পালানোর সময় চারজনকে হাতেনাতে আটক করেছে স্থানীয় জনতা। দু’টি পিস্তল ও বোমা ছিল তাদের কাছে। তারাও জেএমবি সদস্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৫
এনএইচএফ/এএসআর