নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ার বেদখলকৃত দেবোত্তর সম্পত্তি জিউস পুকুর পুনরুদ্ধারের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর বিরুদ্ধে প্রতীকী অনশন ও গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
আইভীকে ‘ভূমিদস্যূ’ উল্লেখ করে বুধবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলে শহরের চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ওই কর্মসূচি পালন করেন সর্বস্তরের সনাতন ধর্মালম্বীরা।
এতে সমর্থন জানিয়ে সেখানে যোগ দেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, বিভিন্ন পেশাজীবী, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা ও সাধারণ মানুষ।
এর আগে এ পুকুর উদ্ধারে মানববন্ধন, প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন সনাতন ধর্মালম্বীরা।
এতে অংশ নেন লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির কমিটির সভাপতি নিরঞ্জন সাহা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নির্মল চ্যাটার্জি, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা সভাপতি চন্দন শীল, নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীপক কুমার সাহা, সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন, মহানগর সভাপতি অরুণ কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার দাস, মহানগর সভাপতি লিটন চন্দ্র পাল ও সাধারণ সম্পাদক নিমাই দে প্রমুখ।
কর্মসূচির এক পর্যায়ে এতে সংহতি প্রকাশ করে মিছিল নিয়ে যোগ দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনার শহিদ মো. বাদল, যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানুল হক নিপু, জাকিরুল আলম হেলাল, শহর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন ভূঁইয়া সাজনু, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাফায়েত আলম সানি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আজিজুর রহমান আজিজ, সাধারণ সম্পাদক রাফেল, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মহসিন মিয়া, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল প্রধান, ১৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজল, ডা. বিধান পোদ্দারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা।
এতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বলেন, আইভীর মা-খালা-ভাইয়েরা দখল করেছে এ সম্পত্তি। মন্দিরের জায়গা দখল করেছেন, মামলার রায় হয়েছে সেটি মানেন না। মাথায় সিঁদুর দেবেন, ঠাকুরের খাইবেন আবার ঠাকুরের সম্পত্তি দখল করবেন এই ভণ্ডামী ছাড়তে হবে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদ মাদ্রাসার জমিও যদি দখল হয় সেখানেও আমি প্রতিবাদ করবো, মাঠে নামবো। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। দেবোত্তর সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়ে যে কয়টা দিন আছেন নারায়ণগঞ্জের মানুষের সেবা করেন। আপনি তো অনেক দিয়েছেন বলেন, দেন না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করতে চায়, তাদেরকে জননেত্রী শেখ হাসিনা আগামীতে আর মনোনয়ন দেবেন না। কারণ তিনি আমাদের ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহিদ মো. বাদল বলেন, আমি আপনাদের দাবির সাথে একমত। এখানে কেউ মুসলিম কেউ হিন্দু, আমি সেভাবে বলতে চাই না। সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। আল্লাহ বলেছেন, যে মানুষকে ভালোবাসে আমি তাকে ভালোবাসি। আমাদের দাবি আদায়ের জন্য আজ আমরা সকলেই এক হয়েছি।
তিনি বলেন, মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জন্য আওয়ামী লীগ কাজ করে। নারায়ণগঞ্জের মাটি আওয়ামী লীগের ঘাটি ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ঘাঁটি। এই আন্দোলন যেন আজকে শেষ না হয়, মঞ্চে বক্তব্যের মধ্যেই যেন শেষ না হয়। আপনাকে আজকে ভোট দেওয়া হয়েছে দেবোত্তর সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য নয়। যদি আপনি গ্রাস না করেন তাহলে আসেন এখানে। শ্মশানের জমি যেভাবে দখল করেছেন সেভাবে এই সম্পত্তি দখল করেছেন। এটি উদ্ধার হবে আমরা প্রস্তুত। শেষ বয়সে এসে আমরা এই সম্পদ উদ্ধার করবো। আওয়ামী লীগের টিকেট নিয়ে আপনি মেয়র হবেন আর আপনার অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে তা হবে না। আপনাকে আর কেউ ভোট দেবে না। এই চেয়ারে বসে আপনি জনগণের জন্য কয়টা কাজ করেছেন হিসাব দেন। হকারদের পুনর্বাসন করেন তারপর তাদের উচ্ছেদ করেন। যদি এই সম্পত্তি ফিরিয়ে না দেন তাহলে এই নারায়ণগঞ্জের মানুষ আপনি ক্ষমা চাইলেও আর ক্ষমা করবে না। যদি আমাদের ফাঁসির কাষ্ঠেও দিয়ে দেওয়া হয় তবুও আমরা এই সম্পত্তি উদ্ধার করবো।
চন্দন শীল বলেন, আমাদের মধ্যে যে সম্প্রীতি সেটি মেয়র বিনষ্ট করতে চায়। আপনাকে সৃষ্টিকর্তা যথেষ্ট দিয়েছেন, ১৭ বছর ধরে আপনি পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র। কিন্তু বলে না শকুনের চোখ সব সময় নিচে। আপনার অবস্থা হয়েছে সেরকম। আপনি শ্মশানের জায়গা দখল করবেন কেন? এর ৭ শতাংশ জমি আপনার লোকজন দখল করলো। আমরা মামলা করবো সিটি করপোরেশন থেকে বলা হলো এটার কোন কাগজ নেই, এটি কোন কথা? একইভাবে এই দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করলেন। দেবোত্তর সম্পত্তি কোনদিন বিক্রি হবে না, হস্তান্তর করা যাবে না। দেবোত্তর সম্পত্তি যে মন্দিরের নামে সে মন্দিরের থাকবে। এসব সম্পত্তি যে মসজিদ মন্দিরের নামে থাকে তাদেরই থাকবে, বিক্রি হস্তান্তর হবে না। আর আপনি বলছেন, কিনে নিয়েছেন। মন্দিরের সভাপতিকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তাকে নিয়ে ধমক দেয়। গোবিন্দ ঘোষ তাকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। উনি হার্টের রোগী শেষ বয়সে এসে এসবে উনি এখন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
তিনি বলেন, একটা টোকাই সুফিয়ান এই ১৭ বছরে এক কামিয়েছেন যে এখন তিনি সর্বোচ্চ করদাতা। তাকে আপনি শত শত কোটি টাকার মালিক বানিয়েছেন। এত টাকা নিচ্ছেন তাও জিহবা লক লক করে। কেন আপনি নারায়ণগঞ্জকে ময়লার ভাগাড় বানিয়েছেন? ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পাশে সকল ময়লা ফেলেন, একটি আস্ত গরু, কুকুর মনে গেলেও সেখানে ফেলেন, কেন? কেন নারায়ণগঞ্জের মানুষ এই ময়লার ভাগাড়ে বসবাস করবে। কেন মানুষ মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে যাবে? এই নারায়ণগঞ্জ আজকে কেন যানজটের শহরে পরিনত হবে। শুধু শ্মশান আর জিউস পুকুর নয়, যেখানেই আপনি জায়গা আর সুযোগ পেয়েছেন দখল করেছেন। নমুনা পাশের রাজউকের জমি, যেখানে আপনি বিল্ডিং তুলে বসে আছেন। রেলওয়ের জমি আপনি দখল করেছেন, মামলা চলছে। এখনো বলছি সময় আছে, জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে এই জিউস পুকুর ফিরিয়ে দিন। এই জলাশয়টাকে আবর্জনামুক্ত করেন। যতদিন আপনার সময় আছে, মানুষের সমস্যার সমাধান করুন, সমস্যা বাড়াবেন না। প্রধানমন্ত্রী সিটি করপোরেশন ঘোষণা করলেও নারায়ণগঞ্জবাসীকে তার সুফল থেকে আপনি বঞ্চিত করেছেন।
খালেদ হায়দার খান কাজল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আপনারা আস্থা রাখুন। তিনিই আপনাদের সুবিচার করবেন। আমরা আপনাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি।
শাহ নিজাম বলেন, এই পুকুর লক্ষ্মী নারায়ণের দেওয়া। যে পরিবার কর্তৃক এটি পুকুর দখলের অভিযোগ উঠেছে, সেই পরিবারকে মেয়র বানাতে আমরাই আপনাদের ঘরে ঘরে ভোটের জন্য ছুটে গিয়েছিলাম। আমার দলের নির্দেশনা ছিল বলেই আমরা গিয়েছিলাম। যারা আজকে আপনাদের হক অধিকার প্রাপ্য কেড়ে নিতে চায়, আপনারা যে অবস্থায় আমাদের ডাকবেন আপনাদের পাশে আমরা থাকবো। কারণ আমাদের কথায় আপনারা ভোট দেন। প্রশাসনের মাধ্যমে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে সেটি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন নয়তো এই আন্দোলন আরো অনেক বড় আকার ধারণ করবে।
শাহাদাৎ হোসেন ভূঁইয়া সাজনু বলেন, হিন্দু সম্পত্তি কেউ দখল করবে আর সেটি আমরা মেনে নেব তা হবে না। আমি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন জানাই আমাদের হিন্দু ভাইদের এই সম্পত্তি যেন দ্রুত তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
সাফায়েত আলম সানি বলেন, আমরা সবাই বাঙালি এটিই ছিল আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। যারা আওয়ামী লীগের মুখোশ পরে দলের বদনাম করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ‘নারায়ণগঞ্জ নগরী স্থাপনের সময়কালে শ্রী ভিকন লাল ঠাকুর শহরের দেওভোগ আখড়া এলাকায় দেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের নামে ‘শ্রীশ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউস বিগ্রহ মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। শত বছর ধরে এই মন্দির নারায়ণগঞ্জের লাখো হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে পবিত্রতা ও শুদ্ধতার কেন্দ্র। স্বর্গবাসী ভিকন লাল পাণ্ডে মন্দিরটির পাশে পূজা-অর্চনা ও আশপাশের অধিবাসীদের সুবিধায় ৩৬৭ শতাংশ জমির ওপর একটি পুকুর খনন করান, যা স্থানীয়দের কাছে জিউস পুকুর নামে পরিচিত। ভূমি জরিপের সিএস (ব্রিটিশ) পর্চায় এই বিশাল সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়। জিয়াউর রহমানের আমল থেকে দেবোত্তর এই সম্পত্তি দখল করতে উঠেপড়ে লাগে মেয়র আইভীর পরিবার। যে নকল দলিল করে এই সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে মেয়র আইভীর মা, দুই ভাই এবং আত্মীয়-স্বজনের নাম রয়েছে। ’
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষায় আমরা কখনো প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতাম না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ দেশে এখন আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা এ দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অবিচল আস্থা রেখে তার দ্বারস্থ হয়েছি। দেবোত্তর এই সম্পত্তিটির বর্তমান মূল্য ১০০ কোটি টাকার ওপর। মেয়র আইভী ও তার পরিবারের দখলদারির কাছে আমরা অসহায়। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২০
এমআরপি