ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত দিবস আজ

শরিফুল ইসলাম ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২০
ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত দিবস আজ ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙ্গন নদীর তীরে মক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য অপরাজেয় ‘৭১

ঠাকুরগাঁও: ০৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়েছিল দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁও।

 

এদিন ঠাকুরগাঁও মহকুমায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে পতন হয় হানাদার বাহিনীর। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের জনগণ ওই দিন ভোরে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। শুরু হয় ঠাকুরগাঁওবাসী ও শ্রমিক জনতার বিজয় উল্লাস।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর সারা দেশের মতো ঠাকুরগাঁয়েও পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালায় নির্যাতন। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে মেতে ওঠে তারা।  

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জাটিভাঙ্গা ও রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়া দিঘির পাড়ে মুক্তিকামী লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ১৭ এপ্রিল জগন্নাথপুর, গড়েয়া শুখাপনপুকুরী এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভারত অভিমুখে যাওয়ার সময় স্থানীয় রাজাকাররা তাদের জড়ো করে মিছিলের কথা বলে পুরুষদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে পাথরাজ নদীর তীরে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।

একইভাবে রানীশংকৈলের খুনিয়া দিঘির পাড়ে গণহত্যা চালানো হয়। হরিপুর ও রানীশংকৈলের নিরীহ মানুষজনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে এনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। মানুষের রক্তে এক সময় লাল হয়ে ওঠে ওই পুকুরের পানি। পরবর্তীকালে এ পুকুর খুনিয়া দিঘি নামে পরিচিত পায়।

এদিকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যেই আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও। সংগঠিত হতে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী মানুষরাও। তারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলে দুর্বার প্রতিরোধ।

ঠাকুরগাঁও তখন ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার এম খাদেমুল বাশার। ২৯ নভেম্বর এই মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। মিত্রবাহিনী যাতে ঠাকুরগাঁও দখল করতে না পারে সেজন্য পাকিস্তানি সেনারা ৩০ নভেম্বর ভূল্লী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকায় সর্বত্র বিশেষ করে ইক্ষু খামারে মাইন পুঁতে রাখে। মিত্রবাহিনী ভূল্লী ব্রিজ সংস্কার করে ট্যাংক পারাপারের ব্যবস্থা করে।
০১ ডিসেম্বর ভূল্লী ব্রিজ পার হলেও মিত্রবাহিনী যত্রতত্র মাইন থাকার কারণে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে পারেনি। ওই সময় শত্রুদের মাইনে দু’টি ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর এফ এফ বাহিনীর কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়।

০২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে সে রাতেই শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটতে শুরু করে। অবস্থান নেয় ২৫ মাইল নামক স্থানে।  

০৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঠাকুরগাঁও শহর শত্রুমুক্ত হয়। সকাল থেকেই ঠাকুরগাঁও শহরে মানুষ জড়ো হতে থাকে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ। হাজার হাজার মানুষ উদ্বেলিত কন্ঠে ‘জয় বাংলা’ বলতে বলতে মুক্ত শহরের রাস্তায় বের হয়ে আসে। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের জনগণ মিছিল নিয়ে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১০ হাজার নারী-পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন দুই হাজার মা-বোন।
 
ঠাকুরগাঁওয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজ্জা বদর বাংলানিউজকে বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের ০৩ ডিসেম্বর এই দিনে ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত হয়। ৩০ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভূল্লী ব্রিজের কাছে অবস্থান নেয়, সেখানে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে না পেরে ঠাকুরগাঁও শহরে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধা, মিত্র বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ অবস্থায় তারা ০২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁও ছেড়ে চলে যায়। অনেক নারী-পুরুষকে প্রাণ, সংগ্রামের বিনিময়, ও অনেক মা-বোন নির্যাতন-ইজ্জতের বিনিময়ে ঠাকুরগাঁওকে হানাদারমুক্ত করা হয়েছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. কেএম কামরুজ্জামান সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ০৩ ডিসেম্বর স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সংগ্রামের মাধ্যমে ঠাকুরগাঁওকে হানাদারমুক্ত করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের ১৩ দিন আগে জেলা শত্রুমুক্ত হয়। ঠাকুরগাঁওয়ের সর্বস্তরের মানুষ এই দিনটিকে উদযাপন করে থাকেন। তবে এবার মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে এই দিনটিকে উদযাপন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২০
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।