কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের দুর্গম চরাঞ্চলের চকচকে বালুতে এখন সবুজের সমারোহে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে । নদনদী অববাহিকার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ বন্যা, খরা, শীত, ঝড়-ঝঞ্জাসহ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে কৃষির বিপ্লব ঘটিয়ে জীবনযাত্রায় আনছেন পরিবর্তনের ছোঁয়া।
বাপ-দাদা আমলের প্রচলিত সনাতন কৃষি চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল চরাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ এখন উন্নত বীজ আর আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষির ব্যাপক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে। ৪ শতাধিক দুর্গম চরাঞ্চলের কৃষকরা চাষাবাদের অযোগ্য পতিত জমিতে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে আনছেন সবুজের বিপ্লব।
সরেজমিনে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের আলগার চরের কৃষকরা জানায়, আগে বালুকাময় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত প্রচলিত বীজের ওপরই নির্ভর করে সামান্য কিছু জমি উৎপাদনশীল করে চাষাবাদ করা হতো। এতে কোন রকমে সংসার চলতো। বন্যার পর বালুকাময় জমির কিছু কিছু স্থানে পলি পড়তো। সেসব স্থানে ধান, বাদাম ও বিভিন্ন কলাই (ডাল) আবাদ করা হলেও পতিতই থেকে যেতো বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল।
আগে চরাঞ্চলের চকচকে বালুকাময় জমিতে ফসল চাষ করলেও প্রকৃতিগতভাবে ফলন হতো অনেক কম। কিন্তু বর্তমানে পানি সেচের ব্যবস্থা থাকায় উন্নতজাতের বোরো ধানের পাশাপাশি ভুট্রা, গম, সরিষা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, টমেটো, মশুর ডাল, খেসারী ডাল, মুগ ডাল, মরিচ, পেঁয়াজ চাষ করা হচ্ছে। এতে ফলন অনেক ভালো হওয়ায় চরাঞ্চলের কৃষকরা তাদের দু:খ-কষ্টের দিনগুলো পেছনে ফেলে আধুনিক চাষাবাদে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন।
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের আলগার চরের কৃষক জাহালম শেখ, শমসের আলীসহ অনেকে বাংলানিউজকে জানান, শহর থেকে উন্নতমানের বীজ সংগ্রহ করতে না পারাসহ আধুনিক পদ্ধতির অজ্ঞতায় চরের মাটিতে ভালো ফলন হতো না। বাধ্য হয়ে বাপ-দাদাদের রেখে যাওয়া সনাতন পদ্ধতিতে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা প্রচলিত বীজ ও কৃষি পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতে হতো। বালু জমিতে রস না থাকায় অধিকাংশ জমিই পতিত পড়ে থাকতো।
বর্তমানে উন্নতবীজের পাশাপাশি শ্যালোমেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ দিয়ে উন্নতজাতের বোরো ধানের পাশাপাশি উন্নতজাতের ভুট্রা, গম, সরিষা, সুর্যমুখী, চিনাবাদাম, টমেটো, মশুর ডাল, খেসারী ডাল, মুগ ডাল মরিচ, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে সাফল্য আসছে। মাসের পর মাস কাউনের ভাত খেয়ে থাকা চরাঞ্চলের মানুষ এখন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, সূর্যমুখী, ভুট্টাসহ উন্নতজাতের নানা ধরনের ফসল-সবজি উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, চরের চকচকে বালুকাময় জমিতে এখন বিভিন্ন ফসল চাষের পাশাপাশি গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি পালনেও এগিয়ে এসেছেন চরবাসী।
কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানায়, জেলায় ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকার সাড়ে ৪ শতাধিক চরের ৪৬ হাজার ৪শ ২৮ হেক্টর জমির মধ্যে বর্তমানে আবাদি জমির পরিমান ৩৫ হাজার ৮৭ হেক্টর। আবাদি এসব বেশির ভাগ জমিতে এখন কৃষকরা লাভজনক ফসল ফলাচ্ছেন।
উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে চরাঞ্চলের মানুষ এখন স্বাবলম্বী হচ্ছেন। চাষাবাদ করে কুড়িগ্রামের আর্থ সামাজিক অবস্থার সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন চরবাসী।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক বাংলানিউজকে জানান, চরাঞ্চলসহ জেলার ১ লাখ ১৯ হাজার কৃষককে কৃষি প্রণোদনার আওতায় উন্নতজাতের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের কৃষকদের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনামূল্যে বীজ, সার দেওয়ার পাশাপাশি লাভজনক ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা গতানুগতিক চাষাবাদ থেকে সরে এসে চরাঞ্চলে আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত অতিরিক্ত ফসল ও সবজি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ভালো মানের বীজে অধিক ফসল উৎপাদন চরের কৃষকদের চাষাবাদে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এফইএস/এমআরএ