সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের নাগরৌহা গ্রাম। গ্রামের একটি বাড়িতে গত দুদিন ধরে চলছে শোকের মাতম।
সোমবার (৬ জুন) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আঁখি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছেন। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। পাশেই শফিউলর মা মাটি চাপড়ে আহাজারি করছেন। সন্তান কোথায় তার?
প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ জানেন না কোথায় শফিউল, আর কি-ই বা তারা বলবেন!
শফিউলের বাবার নাম আব্দুল মান্নান। তিনি তাঁত-শ্রমিক, আবার দিনমজুরের কাজও করেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় শফিউল। ছোট ছেলে আল মামুন উল্লাপাড়া সরকারি কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্বল্প আয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি দুই ছেলেকে লেখাপড়াও করিয়েছেন মান্নান।
২০১৭ সালে উল্লাপাড়া মার্চেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন শফিউল। ২০১৯ সালে ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন তিনি। খেলাধুলার করতেন তাই শরীরও ছিল সুঠাম। সীতাকুণ্ডের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে ফায়ার ফাইটার হিসেবে কর্মরত এ যুবক বিয়ে করেছিলেন আঁখি খাতুনকে। ২০২১ সালে। বেতকান্দি গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি।
শনিবার (৪ জুন) রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডে সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোয় আগুনের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে ইউনিট নিয়ে শফিউল যান যেখানে। এরপর বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর থেকে শফিউল কোথায় কেউ জানে না।
শফিউলের খালাতো বোন ছালমা খাতুন জানান, ডিপোয় আগুনের খবর পেয়ে শফিউলকে বার বার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কল ধরেননি। পরদিন ছোট ভাই মামুন ও মামা আরিফ সীতাকুণ্ডের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে যান। শফিউলের রুমে গিয়ে তাকে পাননি। রুমে ছিল শুধু তার ফোন। কুমিরা ফায়ার স্টেশন কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন শফিউল।
সাবেক ইউপি সদস্য শফিউদ্দিন সরকার ও শিউলী খাতুনসহ অনেকেই জানান, মান্নান অসুস্থ হওয়ায় তার সংসারের হাল ধরেন বড় ছেলে শফিউল। ফায়ার সার্ভিসে চাকরি পাওয়ায় সংসারে উন্নতিও আসে তাদের। শনিবারের ঘটনার পর থেকে নিখোঁজের পরিবারের কেউ খাবার খেতে পারছেন না। তার ৫ মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর অবস্থা করুণ।
শফিউলের মা শাহনাজ বেগমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন এ প্রতিনিধি। কিন্তু আহাজারি-কান্নার কারণে তিনি ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। থেমে থেমে বলছিলেন, শফিউল তাদের প্রথম সন্তান। তার কিছু হলে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না তার। সৃষ্টিকর্তার পানে দুহাত তুলে দিয়ে চিৎকার করছেন। বলছেন, হে আল্লাহ আমার পোলারে ফিরাইয়া দাও।
ফায়ার ফাইটার শফিউলের বাবা মান্নান জানান, ছেলের সন্ধানে তিনি ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা হেড কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন। সোমবার বিকেলে ফিরে এসেছেন। শফিউলকে কোথাও পাননি। ছেলের কিছু হয়ে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাবেন তারা।
বার বার জ্ঞান হারানোয় শফিউলের স্ত্রী আঁখির সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
উল্লাপাড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাহারুল হক সাচ্চু জানান, বড় ভাইয়ের খোঁজে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থান করছেন ছোট ভাই মামুন। পরিবারটির কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই তার।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, খবর পেয়ে আমরা শফিউলের বাড়ি গিয়েছি। পুরো পরিবার শোকে কাতর।
সিরাজগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে গিয়ে শফিউল নিখোঁজ হলেও জীবিত বা মৃত; তার কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি। শফিউলের বাড়ি গিয়ে পরিবারকে সান্ত্বনা জানিয়ে এসেছেন তারা।
শফিউলের পাশাপাশি শনিবার রাতের ঘটনার পর নিখোঁজ রয়েছেন আরও দুজন। তারা হলেন- নওগাঁ জেলার বাসিন্দা ও সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মো. রবিউল ইসলাম এবং একই স্টেশনের ফায়ারফাইটার ও রংপুরের বাসিন্দা ফরিদুজ্জামান।
এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মো. রানা মিয়া, আলাউদ্দিন, মো. শাকিল তরফদার, স্টেশন লিডার মিঠু দেওয়ান, স্টেশন লিডার মো. ইমরান হোসেন মজুমদার ও নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট মনিরুজ্জামান।
সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের লিডার নিপন চাকমা, রমজানুল ইসলাম ও ফায়ারফাইটার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, ৬ জুন, ২০২২
এমজে