ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

একাত্তর

চুয়াডাঙ্গা হানাদার মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর  

জিসান আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০২২
চুয়াডাঙ্গা হানাদার মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর
 

চুয়াডাঙ্গা: আজ ৭ ডিসেম্বর। চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস।

১৯৭১ সালের এ দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে চুয়াডাঙ্গাকে শত্রু মুক্ত করেন বাংলার মুক্তিসেনারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দিনটিকে স্থানীয়ভাবে মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেক প্রত্যাশিত দাবি পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা জানিয়েছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
 
২৫ মার্চের কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের পরই চুয়াডাঙ্গার হাজার হাজার মুক্তিপাগল দামাল ছেলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। একই রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে একদল সৈন্য কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেওয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা শহর রক্ষার জন্য শহরের প্রবেশ পথগুলোতে গাছের ডাল ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। সেই সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছা সেবকদের শহরের শ্রীমন্ত টাউন হলে একত্রিত করে চুয়াডাঙ্গা ট্রেজারি থেকে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করা হয়।
 
এদিকে চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত থাকার খবর শুনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও পরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত যাওয়ার উদ্দেশে একমাত্র সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন।

ওই সময় তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলেচনায় চুয়াডাঙ্গার সার্বিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গাকে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী করার ঘোষণা দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্ত থাকার সুবাদে ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় চুয়াডাঙ্গাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রণাঙ্গনের অন্যতম যুদ্ধাঞ্চল।
 
বিদেশি সংবাদিকদের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা ডেটলাইনে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার ওপর প্রথম বিমান হামলা চালানো হয়।
 
১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ২৮ জন এমপিএ-এর উপস্থিতিতে এক সভায় অস্থায়ী সরকারের রাজধানী ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল চুয়াডাঙ্গায় করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যদিও সিদ্ধান্তটি নিরাপত্তা জনিত কারণে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই খবরটি দ্রুত বিদেশি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় চুয়াডাঙ্গা।  
 
এরপরই মূলত চুয়াডাঙ্গার ওপর ব্যাপকভাবে বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। একই সঙ্গে যশোর সেনানিবাস থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করে। চুয়াডাঙ্গা প্রবেশের পরই হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অগণিত সাধারণ মানুষকে হত্যা করে শহর দখল করে নেয়। এ খবরে দ্রুত দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।
 
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুবনেতা বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুনের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার যুবক-তরুণদের একত্রিত করে ২২ এপ্রিল ভারতের হৃদয়পুর শিবিরে ১২০ জন যুবক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প চালু করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনা সুষ্ঠু ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১১ জুলাই বাংলাদেশের সমগ্র যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তারা যে যেখানে যুদ্ধরত ছিলেন, তাঁকে সে অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ এলাকার সমস্ত উপদলকে একক অধিনায়কত্বের আওতায় আনা হয়। চুয়াডাঙ্গা ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে। চলতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধ।
 
৫ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহের কাছে বাগোয়ান গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তার সহযোদ্ধা পিন্টু, হাসান, খোকন, কাশেম, রবিউল, রওশন, তারিক ও আফাজউদ্দিন নামে আট বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের জগন্নাথপুর গ্রামের দু’টি কবরে দাফন করা হয়। যা এখন আটকবর নামে পরিচিত। এছাড়া ৭ আগস্ট জীবননগর থানার ধোপাখালি সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়।
 
সেপ্টেম্বর মাসে ৮ নম্বার সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল মনজুর দায়িত্ব নেন। তিনি যুদ্ধ বেগবান করা ও বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন আনেন। যুদ্ধ এগিয়ে যায় চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে জীবননগর দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় দর্শনা। ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা থেকে শত্রুদের হটিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিকামী জনতা। বিজয়ের বেশে চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। স্বদেশের পতাকা উড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আনন্দ উল্লাস করে এলাকার মুক্তিকামী মানুষ।
 
এতশত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও হানাদার মুক্ত হওয়া জেলায় এখনো অনেক দাবি অপূরণ রয়ে গেছে। যা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হতাশাজনক বলে মনে করেন অনেকে।
 
সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর ফটিক বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭১ এর ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে কোথাও উল্লেখ করা হয় না যে  বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী চুয়াডাঙ্গার নাম।
 
জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার আব্দুল মাবুদ জোয়ার্দার জানান, দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে জেলায় এখনো তৈরি হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদদের সম্মানে একটি স্মৃতিস্তম্ভের দাবি তার।
 
জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার আবু হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের দাবিগুলো পূরণের জন্য বারবার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠিপত্র দেওয়ার পর আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। তাই শুধু আশ্বাস না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের দাবি পূরণের আহ্বান জানান তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।