ময়মনসিংহ: প্রায় আট বছর আগে সংরক্ষণ করে চিহ্নিত করা হয়েছে পৈশাচিক গণহত্যার স্বাক্ষর বধ্যভূমি। কিন্তু ময়মনসিংহ নগরীর ব্রহ্মপুত্র নদছোঁয়া শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যানের সবুজ বেস্টনীর মধ্যে এ বধ্যভূমি এখন পড়ে রয়েছে অযত্ন-অবহেলায়।
পোস্টারে আড়াল হতে বসেছে মুক্তিকামী বাঙালিদের ত্যাগের এ স্মৃতিচিহ্ন। নূন্যতম রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় দুষ্টচক্রের খপ্পরে বধ্যভূমির নামফলকও পড়েছে রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটে।
মুছে যেতে বসেছে এ নামফলকটি। ফলকটি ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়ার পাশাপাশি তার ওপর কালো কালিতে একজনের নাম লিখে রাখা হয়েছে। আবার তার ঠিক ওপরেই সেঁটে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক দলের পোস্টার। কোনোরকম নিরাপত্তা বেস্টনী বা সীমানা প্রাচীর না থাকায় প্রতিনিয়তই অবমাননা করা হচ্ছে অনাদরে পড়ে থাকা বধ্যভূমির।
ফলে স্থানীয়রাও সহজে এ বধ্যভূমি ঠাহর করতে পারছেন না। অথচ উদ্যোগ নেওয়া হলে এ বধ্যভূমিকে ঘিরেই মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব ছিলো।
গত সোমবার (২৮ নভেম্বর) সরেজমিন ঘুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ বধ্যভূমির এমন হাল চোখে পড়লো।
দেখা গেলো, নিরীহ মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করার এ স্থানটিতে ২০০৮ সালের ০৩ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও ময়মনসিংহ পৌরসভার উদ্যোগে বধ্যভূমির উদ্বোধন করা হয়। এর ঠিক আট বছরের মাথায় বধ্যভূমির গণহত্যা ফলকের অনেক লেখাই মুছে গেছে।
উদ্বোধনের তারিখ ও উদ্বোধকের নামও দুষ্টচক্রের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এদিকটায় কারও কোনো দৃষ্টি না থাকায় বোঝার উপায় নেই, এটি একাত্তরের চেতনা বিকাশের ঐতিহাসিক এক স্থান!
বধ্যভূমির সারসংক্ষেপ তুলে ধরে ময়মনসিংহের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী মানুষদের এখানে ধরে এনে হত্যা করেছিল। তাদের মরদেহ স্তূপাকারে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখা হয়। এটিই অন্যতম ‘গণকবর’।
পাকিদের গণহত্যায় ব্যবহৃত এ বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলেও এখন এটি অনেকটাই অরক্ষিত রয়েছে। বধ্যভূমির চারপাশও অপরিচ্ছন্ন। ধূলো লেপ্টে রয়েছে বধ্যভূমিতে। এসবের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত এ বধ্যভূমিকে অবমাননা করা হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী কমান্ডার আনোয়ার পাশা বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয় তরুণ প্রজন্ম এবং বয়স্করাও বধ্যভূমির ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না।
মূলত অযত্ন-অবহেলার কারণেই বধ্যভূমিটি চেনা দায় হয়ে পড়েছে। পাকিদের নির্মমতার শিকার বাঙালিদের প্রতিনিয়তই অবমূল্যায়ন ও অসম্মান করা হচ্ছে। একাত্তরে পাকিদের হটানো এ বীর মুক্তিযোদ্ধার কথার বাস্তব প্রতিফলনও দেখা গেলো।
এদিন বিকেলে বধ্যভূমির অবস্থা দেখতে সেখানে গেলে আলাপ হয় সেখানকার স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে। বধ্যভূমিটি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে তো কোনো বধ্যভূমি নাই।
এ বাসিন্দার কথায় বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই আবুল মনসুর সড়কের ঠিক সামনেই সবুজ বেস্টনীর নিচে অনেকটাই পরিত্যক্ত এ বধ্যভূমির দেখা মেলে। বধ্যভূমির মলিন চেহারা দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, বধ্যভূমিটির কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। জয়নুল উদ্যানে মুক্ত বাতাসে নির্মল নিঃশ্বাস নিতে আসা কলেজ ছাত্র রুবায়েত হোসেনের কাছেও অচেনা এ বধ্যভূমি।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, খোঁজখবর নিয়ে এ বধ্যভূমিটি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬
এমএএএম/এসএনএস