দুর্নীতির অভিযোগ আর গুটি চালাচালিতে সংকটে পড়েছে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। পঞ্চমবারের মতো সংস্থাটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েও ক’দিনের মাথায় সেপ ব্ল্যাটার পদত্যাগ করায় সে সংকট আরও ঘনীভূত হলো।
দুর্নীতির অভিযোগে শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের মধ্যেই গত ২৯ মে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অনুষ্ঠিত ফিফার কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচনে টানা পঞ্চমবারের মতো বিজয়ী হন ব্ল্যাটার। কিন্তু সভাপতি পদে দায়িত্ব নেওয়ার সপ্তাহ না পেরোতেই দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ব্ল্যাটার। যদিও নির্বাচনে জয়লাভ করার পর সমালোচকদের তোপ দেগে ব্ল্যাটার বলেছিলেন, ‘কেন আমি সরে দাঁড়াবো? এতে মনে হবে ভুল করেছি, স্বীকার করে নিচ্ছি’।
ব্ল্যাটার কেন সরে দাঁড়ালেন? বলা হচ্ছে, ইউরোপীয় ফুটবলের আঞ্চলিক সংস্থা উয়েফার সঙ্গে ফিফার এক অঘোষিত লড়াইয়ে হার মেনেই যেন পদত্যাগে বাধ্য হলেন ব্ল্যাটার।
উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনি, সাবেক পর্তুগিজ তারকা ফুটবলার লুই ফিগোর মতো ফুটবল কর্মকর্তারা জোট বেঁধেছিলেন ব্ল্যাটারের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপ ও লাতিন ফুটবলের দেশগুলো ব্ল্যাটারবিরোধী অবস্থান সংহত করে।
অন্যদিকে, ব্ল্যাটারের পক্ষে ছিলো এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ক্যারিবীয় অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত কম শক্তির ফুটবল জাতিগুলো। এদের ভোটের জোরেই পঞ্চম দফায়ও সভাপতি নির্বাচনে জয়ী হন ব্ল্যাটার।
ফিফা সভাপতি হিসেবে ব্ল্যাটারের ১৭ বছরের সময়কালে ফুটবল ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী একথা খোদ ব্ল্যাটারবিরোধীরাও স্বীকার করবেন। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের শক্তিশালী দেশগুলোর জোট লাতিন অঞ্চলের ফুটবল সংস্থা ও ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা ব্ল্যাটারকে সরানোয় ছিল বদ্ধপরিকর।
৯০ পরবর্তী ফুটবলের রমরমা বাণিজ্য এবং ফুটবল কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ অনেক আগ থেকেই করে আসছিল উয়েফা ও লাতিন ফুটবল সংস্থাগুলো। অভিযোগের নিশানা থেকে বাদ যায়নি বিগত সময়ে আয়োজিত বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টগুলোও।
সেই অভিযোগের ধারাবাহিকতায় গত ২৭ মে জুরিখের বিভিন্ন স্থান থেকে শীর্ষ পর্যায়ের সাত ফিফা কর্মকর্তাকে আটক করা হয়। আটক প্রায় সবাই ব্ল্যাটারপন্থি। এ ঘটনায় ব্ল্যাটারবিরোধীরা আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে জয়ী হয়েও ফিফা সভাপতি পদত্যাগে বাধ্য হন।
দুর্নীতির অভিযোগের শূলে যারা
ব্ল্যাটারপন্থি ওই গ্রুপ মিলিয়ে ফিফার নয় কর্মকর্তাসহ মোট যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে, এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই তদন্ত চালাবে মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই। আটক সাতজন হলেন ফিফার সহ-সভাপতি ও কনকাকাফ সভাপতি জেভরি ওয়েব, ফিফার সাবেক সহ-সভাপতি জ্যাক ওয়ার্নার, ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের সভাপতি হোসে মারিয়া মারিন, কোস্টারিকা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি এডুয়ার্ডো লি, ভেনিজুয়েলা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি রাফায়েল এসকুইভেল, কনমেবল সহ-সভাপতি ফিগুয়েরেদো এবং দুই ফিফা কর্মকর্তা হুলিও রোচা ও কস্তাস তাক্কাস।
এরা সবাই নব্বইয়ের দশক থেকে ফুটবল সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ হাজির করেছে মার্কিন বিচার বিভাগ। বিভিন্ন মার্কিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা দুর্নীতি করেছেন বলেই এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে বলে দাবি স্থানীয় মিডিয়ার।
এছাড়া, ২০১৮ ও ২০২২ (যথাক্রমে রাশিয়া ও কাতার) বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ বেছে নিতে ফিফা কর্মকর্তারা ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের পুলিশ। বিশ্বকাপ সংক্রান্ত দুর্নীতির বিষয়টি দেখছে সুইস আইন ও বিচার বিভাগ। টিভি স্বত্ব কেনাবেচা, বিপণন, পৃষ্ঠপোষকতাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফিফা কর্মকর্তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্রীড়া বিপণন প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমও এর সঙ্গে জড়িত বলে কথা উঠছে।
বলা হয়, বাণিজ্যিক প্রয়োজনে হলেও ব্ল্যাটার ফুটবলকে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছেন ঠিকই। যার প্রমাণ ব্রাজিল বিশ্বকাপে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর নান্দনিক ফুটবলের প্রদর্শন। ক্যারিবীয় দেশ কোস্টারিকার পারফরম্যান্স ফুটবলপ্রেমীদের চোখে এখনও লেগে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের ফুটবলের শক্তি ও সম্ভাবনাও দেখেছে ব্রাজিল বিশ্বকাপ।
কে হবেন ফিফা সভাপতি?
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হলো- সেপ ব্ল্যাটারের শূন্য আসনে কে বসবেন? যিনি বসবেন, তিনি কি ফুটবলকে ইউরো ও লাতিন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ করে রাখবেন? ৯০ পরবর্তী সময়ে ফুটবল বাণিজ্যের যে প্রসার এবং তারই হাত ধরে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়া ফিফাকে কি তিনি দুর্নীতি মুক্ত করতে পারবেন?
সেই পারবেন কি পারবেন না বিষয়গুলো সামনে রেখে এখন ফিফা সভাপতির শূন্য পদ দখলে অনেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
প্রিন্স আলি বিন আল হুসেইন
ফিফা সভাপতি হওয়ার দৌঁড়ে সবার চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন জর্দান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান প্রিন্স আলি বিন আল হুসেইন। সবচেয়ে কমবয়সী এই ফিফা সহ-সভাপতি সদ্য সমাপ্ত সভাপতি নির্বাচনে ছিলেন ব্ল্যাটারের প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বচনী ইশতেহারে তিনি ফিফা সভাপতির একক ক্ষমতাও কিছুটা কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন।
ফিফায় নারী ফুটবলের প্রসারে কাজ করায় প্রিন্স আলি বিশ্বব্যাপী এক পরিচিত নাম।
মিশেল প্লাতিনি
ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে বিবেচিত সাবেক ফরাসি তারকা ফুটবলার মিশেল প্লাতিনি। ফিফার সহ-সভাপতি ও উয়েফার এই সভাপতি সোচ্চার ছিলেন ব্ল্যাটারবিরোধী প্রচারণায়।
৯২ সালে ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ফুটবল কর্মকর্তা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন প্লাতিনি। যদিও এই কর্মকর্তা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ব্ল্যাটারপন্থিই ছিলেন এবং ব্ল্যাটারের সহযোগিতাতেই উয়েফার একচ্ছত্র ক্ষমতা যায় প্লাতিনির কাঁধে। কিন্তু পরে ফিফা ও উয়েফা দ্বন্দ্ব, ফুটবল বাণিজ্য, টিভি স্বত্ব, বিপণন প্রভৃতি নিয়ে ব্ল্যাটারবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন প্লাতিনি।
প্লাতিনির বিরুদ্ধে ফুটবলকে ইউরোপকেন্দ্রিক করে রাখার অভিযোগ রয়েছে ফুটবলের প্রান্তিক দেশগুলোর।
মিখায়েল ভ্যান প্রাগ
রয়্যাল ডাচ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ফিফার নির্বাহী কমিটির ক্ষমতাধর সদস্য ভ্যান প্রাগ। সদ্য অনুষ্ঠিত সভাপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও প্রিন্স আলির পক্ষ নিয়ে ব্ল্যাটারবিরোধী প্রচারণায় ছিলেন সরব।
‘সবার জন্য ফুটবল’ এই প্রচারণায় সক্রিয় ভ্যান প্রাগ সফল ব্যবসায়ী ও ডাচ ফুটবলের ক্ষমতাধর এক ব্যক্তিত্ব। ফিফা সভাপতির শূন্য চেয়ারে আসীন হতে তিনিও প্রস্তুত।
এছাড়া, সাবেক পর্তুগিজ ফুটবলার লুই ফিগো, আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশনের সভাপতি ঈসা হায়াতু, যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল সংস্থার সভাপতি সুনীল গুলাতিসহ আরও বেশকিছু নাম উঠে আসছে সভাপতি দাবিদার হয়ে।
** ফিফার কর্মকর্তারা ঘুষ নিতে রাজি হয়েছিলেন
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৫
এমজেএফ/এইচএ/