ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

খেলা

ভিউকার্ডের ম্যারাডোনা: ওরা আমাকে এত মারে কেন?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
ভিউকার্ডের ম্যারাডোনা: ওরা আমাকে এত মারে কেন? ছবি: সংগৃহীত

ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার ভক্ত কখনও হয়ে উঠতে পারিনি। আদতে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারে তার খেলা দেখার সৌভাগ্যই আমাদের প্রজন্মের তেমন একটা হয়নি।

ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকা ম্যারাডোনা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যখন ‘ঈশ্বরের হাতের’ সহায়তায় গোল করে তার শহর বুয়েন্স এইরেস মাতিয়ে তোলেন সেই মাতমের জোয়ার এসে পড়েছিল দুনিয়ার আরেক প্রান্তে এই বাংলাদেশের ঢাকার রাস্তায়। বুয়েনস এইরেসের অলিগলিতে মারামারি আর ফুটবল নিয়ে অদম্য শৈশব কাটানো ম্যারাডোনা সামরিক শাসনের জাঁতাকল থেকে বের হওয়া বিপর্যস্ত আর্জেন্টিনাকে যখন এনে দেন বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ—তখন সেই আনন্দের সমান ভাগিদার হয়ে ওঠেন ফুটবলপ্রেমী বাংলাদেশিরাও। তবে সেই আনন্দ উপভোগের সুযোগ তখনও আমাদের প্রজন্মের হয়নি, কেননা ফুটবল দেখার বয়সেই তখনও আমরা পা দেইনি।

১৯৯০-এ চাঁদা তুলে কেনা ৩ নম্বর ফুটবলে অল্পবিস্তর লাথি দেওয়া শিখেছি তবে তা পাড়ার গলিতে বা গ্রামের বাড়ির উঠানেই সীমাবদ্ধ—মাঠে তখন দাপিয়ে বেড়ান পাড়ার বড় ভাইয়েরা। আর তাদের মুখেই নিত্য শুনতাম একটি নাম—ম্যারাডোনা। অনেক পরে জেনেছি ম্যারাডোনা নয়, তার নামের উচ্চারণ—মারাদোনা। কিন্তু তাতে কী এসে যায়, ফুটবল জাদুকর আমাদের কাছে এখনও রয়ে গেছেন শৈশবের সেই ম্যারাডোনা হয়েই।

১৯৯৪ সালে ৩৩ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্রে যান ম্যারাডোনা। সারা বাংলাদেশে তখন ফুটবলের জোয়ার, আবাহনী-মোহামেডানে উদ্দাম হয়ে ওঠে ঢাকা স্টেডিয়াম। ফুটবল নেশায় তখন আমরাও বুঁদ হয়ে গেছি। আমাদের সবার ঘরে ঘরে তখন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পোস্টার-পতাকা। আমাদের বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে তখন রজার মিলা-গায়কোচিয়া-রোমারিওর ভিউকার্ড। তবে এর মধ্যে একটি ভিউকার্ড আর সবগুলো চেয়ে আলাদা, সেটি জাদুকর ম্যারাডোনার—ওরা আমাকে এত মারে কেন?

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ৪–০ গোলে গ্রিসকে উড়িয়ে দিয়ে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে দুর্দান্ত সূচনা করে আর্জেন্টিনা। পরের ম্যাচেই নাইজেরিয়াকে ২–১ গোলে হারায় আলবিসিলেস্তেরা। কিন্তু এরপর ওলট-পালট হয়ে যায় সবকিছু। নিষিদ্ধ ওষুধের নমুনা রক্তে পাওয়ায় বিশ্বকাপ থেকেই বহিষ্কৃত হন ম্যারাডোনা। যথারীতি খেই হারানো আর্জেন্টিনাও টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে। ম্যারাডোনার নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে খোদ বুয়েনস এইরেসে কী হয়েছিল জানি না, তবে ঢাকায় নেমেছিল শোকের মাতম।

আজ ম্যারাডোনার মৃত্যুর দিনে একটি স্মৃতিই বার বার মনে আসছে, চোখে ভাসছে বন্ধু শরীফের অংক বইয়ের ভাঁজে প্রথম দেখা সেই ভিউকার্ড—ওরা আমাকে এত মারে কেন?

শৈশবজুড়ে বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় দলবেঁধে মারামারি করে বেড়ানো ম্যারাডোনা জীবনে কম মার খাননি। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার আগে ১৯৯১ সালের শেষ দিকে কোকেন সেবনের দায়ে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। সেই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর নিজের ফিটনেস ফিরে পেতে ‘এফিড্রিন’ সেবন করতেন বলে নিজেই বহুবার বলেছেন ম্যারাডোনা। ফিফার অনুমোদন নিয়েই নাকি তিনি সেই ওষুধ সেবন করতেন। ফিফা ষড়যন্ত্র করেই তাকে নিষিদ্ধ করে এমনটাও মনে করে ম্যারাডোনার অনেক ভক্ত। ম্যারাডোনা আবার কখনও বলেছেন দ্রুত ফিটনেস ফিরে পেতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সময়টায় শক্তিবর্ধক পানীয় পান করতেন, সেটাতে যে এফিড্রিন ছিল তা তিনি জানতেন না।

প্রকৃত সত্য কী তা আমাদের জানা হয়নি। ম্যারাডোনা আজ নেই—সেই সত্য জানার আর উপায় নেই, দরকারও নেই। ম্যারাডোনার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী কত অগণিত মানুষ শিখেছে ফুটবল প্রেম, আর সেই প্রেমের জন্য কতটা মরিয়া হয়ে ওঠা যায় তা ম্যারাডোনা জীবনভর দেখিয়ে গেছেন। উচ্ছ্বা-হতাশা, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, গৌরব ও গঞ্জনা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়েই থেকেছে ম্যারাডোনার সারাজীবন। নব্বই বিশ্বকাপের ফাইনালে বিতর্কিত পেনাল্টিতে গোল খেয়ে হেরে গেলে বেদনায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন ম্যারাডোনা, আর তার ভিউকার্ড হাতে কাঁদে অগণিত শিশু যাতে লেখা—ওরা আমাকে এত মারে কেন? 

এম জে ফেরদৌস, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর

বাংলাদেশ সময়: ০২০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।