ময়মনসিংহ: ব্রহ্মপুত্র নদ ছোঁয়া ময়মনসিংহ শহরের সোনালী ব্যাংক জোনাল অফিসের পাশেই গৌরীপুর লজ। গৌরীপুরের রামগোপালপুরের রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায়ের নির্মিত বিদ্যাপীঠ, রঙিন কাঁচের কারুকার্যের প্রাসাদ, কৃষ্ণ মন্দির ও প্রাসাদের প্রধান সুরঙ্গ পথ যে কাউকে মুগ্ধ করে।
প্রাসাদের প্রধান সুরঙ্গ থেকে একটু এগিয়ে গেলে দু’টি সিংহের মুখোমুখি অবস্থানে সিমেন্ট, চুন আর কাঁচ দিয়ে নির্মিত ঐতিহাসিক সিংহ দরজা চোখে পড়ে।
তখন ডানে-বামে পেছনে রাজপরিবার, অতিথি আর কর্মচারীদের জন্য তৈরি পৃথক পৃথক শান-বাঁধানো পুকুরঘাট ভ্রমণ পিয়াসীদের মনে জাগায় অদম্য কৌতূহল। কল্পনায় ভাসে তাদের আভিজাত্যের কথা।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর লজের এ চিত্র নান্দনিক। শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে রাজা-জমিদারদের তীর্থ স্থান গৌরীপুর উপজেলাতেও রয়েছে এমন আরো চোখ জুড়ানো নানা স্থাপত্যশৈলী।
সময়ের স্রোতধারায় এসব জীর্ণ স্থাপত্যকীর্তি এখনো কিংবদন্তি। আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
রাজা-জমিদারদের নজরকাড়া এসব স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে অনেক আগে থেকেই দাবি উঠেছিল পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও এ দাবি পূরণ হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটনের এ অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উপজেলা প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দূররে শাহওয়াজ বাংলানিউজকে বলেন, এখানে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার মতো রয়েছে পর্যাপ্ত চাহিদা ও উপকরণ। আছে অমিত সম্ভাবনাও। এসব স্থাপত্যকীর্তি নিয়ে গড়ে উঠতে পারে গবেষণা কেন্দ্রও। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।
গৌরীপুরে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধিস্থল, বারো জমিদারের সুনিপুণ কারুকার্যে নির্মিত প্রাচীন ভবন, অনন্ত সাগর, উসমান খাঁর কেল্লা¬, নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার (র.) মাজার, গোলপুকুর, বৃত্তাকার দ্বীপ, ছিমুরানীর দীঘি, গৌরীপুর সরকারি রাজেন্দ্র কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি কলেজ (সুরেন্দ্র কান্ত লাহেড়ি ভবন), পামবীথি সড়ক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রামগোপালপুরের সিংহ দরজা, শানবাঁধানো ঘাট, বোকাইনগরের শাহী মসজিদ ইতিহাসের সাক্ষী দিচ্ছে।
দৃষ্টি জুড়িয়ে যায় এসব স্থাপত্যশৈলী অবলোকনে। জমিদার মহারাজা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী, রাজা কাশীকিশোর রায় চৌধুরী, যুগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, হরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীসহ গোঁসাইবাড়িসহ মোট বারটি স্থানে জমিদারদের পুরাতন ভগ্ন বসতবাড়ি’র রয়েছে নজরকাড়া দৃষ্টি।
এসব মনোমুগ্ধকর পুরাতন কীর্তি দেখে মনের চাহিদা পূরণের জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিনই এসব স্থানে ভিড় জমায়। বিকেল-রাত পর্যন্ত শীত ও গ্রীষ্মে অজস্র দর্শনার্থী ছুটে আসেন এখানে।
মনোরম কারুকার্যের ভবানীপুরের জমিদার জ্যোতিশ চন্দ্র চৌধুরী বাড়ির গভীর পুকুর এখন আর নেই। তবে বাড়ির শেষ চিহ্নটুকু এখনো রয়েছে অক্ষয় হয়ে।
উপজেলার বোকাইনগরে আছে খাজা উসমান খাঁর কেল্ল¬া, সম্রাট আলমগীরের আমলে নির্মিত শাহী মসজিদ আর হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার (র.) মাজার।
শাহ মারুফের মাজার, কালীবাড়ি ও কালীবাড়ির প্রাচীন মঠ, জঙ্গলবাড়ির বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁর বংশধর ফিরোজ খাঁর স্ত্রী গৌরীপুরের কেল্লা তাজপুরের দেওয়ান উমর খাঁর মেয়ে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধিস্থল, শাহগঞ্জে উঁচু টিবির উপরে হযরত চুপশাহ (র.) মাজার প্রথম দেখায় পর্যটন পিয়াসীদের আকৃষ্ট ও মনে দোলা দেয়।
বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধিস্থলে কুন্দকুসুম গাছগুলো বীরাঙ্গনা সখিনার পাশে আজো ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে টিকে আছে। এটি যে কারো মনকে এক অচেনা সুখের অসুখে পতিত করে।
এছাড়া তাজপুরের কেল্লা, শহরে কৃষ্টপুর জমিদার সুরেন্দ্র প্রসাদ লাহিড়ীর দৃষ্টিনন্দন বাড়ির ভবন রয়েছে।
মহিলা কলেজের পেছনে স্মৃতিচিহ্ন বিলুপ্ত রাণী পুকুরটিও দেখতে ভীষণ সুন্দর। এটি দেখে চোখের পলক পড়তে চায় না। জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী নিজ বাড়িতে নাট্যমন্দির এবং পরবর্তী সময়ে দোতলা থিয়েটার হল বা নাটক ঘর নির্মাণ করেন। এ নাট্য মন্দিরের সঙ্গে প্রাচীন দুর্গা মন্দির।
স্থানীয় ইউএনও দূররে শাহওয়াজ বলেন, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে স্থাপত্যশৈলীগুলোর তালিকা তৈরি করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বীরঙ্গণা সখিনার মাজারের উন্নয়ন কাজের জন্যও মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৪