গায়ে পাতলা একটি শার্ট। পৌষের শীত মাঘের শক্তি নিয়ে একেবারে হাড় অবধি আক্রমণ শুরু করেছে।
সকাল তখন সাড়ে দশটার মতোন বাজে। বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি সদরে আসতে লেগেছে এক ঘণ্টার কিছু বেশি। হোটেলে ভাত খেয়ে, দোকান থেকে ছাতা কিনে রওয়ানা দিতে দিতে সোয়া এগারোটা বাজলো। পথে দেখা রনিন পাড়ার কারবারি আর তার স্ত্রীর সঙ্গে। তারা সপ্তাহের বাজার সারতে এসেছিলেন সদরে।
এ অভিযান নিয়ে শুরু থেকেই এক ধরনের শঙ্কা ছিলো। যে এলাকায় যাচ্ছি তার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই সতর্ক করে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীও আমাদের কীভাবে গ্রহণ করে সেটিও একটি ব্যাপার। তার উপর আকাশের এমন ব্যবহার। কালো আকাশের সাথে মুখটাও কালো করে রনিন পাড়ার পথে রওয়ানা দিলাম।
ঝিরিতে নামতেই মুষলধারে বৃষ্টির আক্রমণ। শীতের মরা ঝিরি বৃষ্টির জলের ধারাতে ফুল ফেঁপে উঠতে লাগলো। আনমনে তাড়া এলো, তাড়তাড়ি এ ঝিরি পথটুকু ছাড়াতে হবে। একবার যদি এ ফুলে উঠা জল হড়কা বান বা ফ্লাশ ফ্ল্যাডে রূপ নেয় তাহলে আর রক্ষা নেই।
জুতো হাতে নিয়ে কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর ছাতা মাথায় ছপ ছপ করে ঝিরি পেরোতে লাগলাম। ঝিরির শেষ মাথায় যেখান থেকে পাহাড়ি পথ শুরু সে অবধি যেতেই বৃষ্টি কমে এলো। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি তাতো হয়েই গেছে। ছাতা মাথায় থাকলেও একেবারে কাকভেজা অবস্থা। জুতো ভিজে গেছে। গায়ে একটা পাতলা শার্ট।
পাহাড়ি পথে পা বাড়ালাম। যত উপরে উঠছি মেঘ কুয়াশা চেপে ধরছে। সরু পাহাড়ি ট্রেইল কাদায় মাখামাখি একেবারে পিচ্ছিল অবস্থা। আমরা চলেছি সিপ্পি অভিযানে। সিপ্পি আরসুয়াং এ দেশের ট্রেকারদের কাছে অবশ্য গন্তব্য একটি পাহাড় চূড়া হিসেবে। এখানে যাওয়ার অনেকগুলো রাস্তা আছে। আমরা যাবো রনিন পাড়া হয়ে।
রোয়াংছড়ি থেকে রনিন পাড়া যেতে ছ’সাত ঘণ্টা লাগে। রনিন পাড়ায় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প রয়েছে। এ কারলে রোয়াংছড়ি থেকে রনিন পাড়া অবধি পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। শুকনো পেলে বোধহয় ভালোই হতো, কিন্তু বৃষ্টিতে এ রাস্তার মজা একেবারে টের পাইয়ে ছাড়লো। পাহাড়ি লাল মাটিতে একেবারে গোঁড়ালি অবধি ডুবে যাচ্ছে। টেনে পা তুলতেই দেখি জুতোয় মাটি লেগে অনেক ভারি হয়েছে গেছে। খাঁড়াইয়ের জায়গাগুলোতে পা টিপে টিপে নামতে হচ্ছে। পড়ে গেলে একাবারে ধরনি তলে।
এমন দুরাবস্থার মাঝে আবার শাফিন ঘোষণা করলো তার শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছে। ট্রেকিং সে এর আগে করেনি। সামনে আরও অনেক রাস্তা পড়ে আছে। এখন কিছুই করার নেই, যেতেই হবে। তাই তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। তবে এই যন্ত্রণা ভুলে থাকার উপলক্ষ পেয়ে যাচ্ছিলাম পাহাড়ি রাস্তার প্রতি বাঁকে বাঁকে। বৃষ্টির হালকা ছাঁট আর মেঘের বন্ধুতায় চারপাশের পাহাড় ঢেকে আছে আবছা কুয়াশা মোড়া ধূসরতায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে হয়তো এই সৌন্দর্যের মাত্রা অন্য ধরনের হতো।
কিন্তু এ সৌন্দর্যও তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। খাঁড়াইয়ের মাথায় উঠে জিরানোর মাঝে এমন আদর মাখানিয়া প্রকৃতি দেখতে দেখতে ভুলতে লাগলাম শীতের অত্যাচার, বৃষ্টির দৌরাত্ম্য আর পথের বিভীষিকা।
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ০১৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৬
এএ