ঢাকা: পর্যটন বর্ষের মূল লক্ষ্য দেশে বিদেশি পর্যটক নিয়ে আসা। সেই প্রচেষ্টায় এবার বছর জুড়ে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় ছাড় দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে বাংলাদেশ।
দেশের পর্যটন সংশ্লিষ্ট অনেকের নজরে এসেছে বিষয়টি। তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, ট্যুরিস্ট স্পট মানেই কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবানসহ কয়েকটি জায়গার কথা আসছে। কিন্তু বিদেশি যেসব ট্রাভেলার বাংলাদেশে ঘুরতে আসে, তাদের কাছে বাংলাদেশের মূল আকর্ষণ এসব স্পট নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট-এর নির্বাহী পরিচালক ও সাউথ এশিয়ান ট্যুরিজম ফেডারেশনের সভাপতি রেজাউল একরাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘মানুষ সব সময় নন ট্র্যাডিশনাল জিনিস পছন্দ করে। ওরা পাঁচ তারকা মানে থেকে অভ্যস্ত, তাই বাংলাদেশে তাদের পছন্দ হয় কুঁড়েঘর।
তিনি বলেন, ওরা পাকা রাস্তায় বরাবর হাঁটে, তাই পছন্দ করে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটতে। ওরা শহরের ইলেকট্রিক লালবাতি সবসময় দেখে, তাই বাংলাদেশে এলে তারা দেখতে চায় জোনাক পোকা। ওরা সব সময় গাড়িতে করে চলে, তাই মেঠোপথে সুপারি গাছের ঠোলার মধ্যে কেউ তাদের টেনে নিয়ে গেলে তারা সীমাহীন আনন্দ পায়।
রেজাউল একরাম বলেন, শেকড়ের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে। ওরা দেখতে চায় আমাদের শেকড়। যেখান থেকে গড়ে উঠেছে আমাদের শহর। তার চায় আমাদের কালচারটা দেখতে। এজন্য পুরান ঢাকা তাদের পছন্দের তালিকায়। সেখানের অকৃত্রিম কালচার দেখে তারা তৃপ্তি পায়।
সাউথ এশিয়ান ট্যুরিজম ফেডারেশনের এই সভাপতি আরও বলেন, মেকি জিনিস আর বড় বিল্ডিং এমনিই দেখা যায়। কিন্তু যে জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে তার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে।
একই প্রশ্নে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ পারভেজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ট্র্যাডিশনাল আকর্ষণের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা এবং মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার সংস্কৃতিকে বেশি পছন্দ করে বিদেশি পর্যটকরা।
১৫ বছর থেকে দেশে বিদেশি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে মিশছেন ‘ট্রিপ টু বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদ হাসান খান। প্রতি মাসে কয়েকটি বিদেশি ট্যুরিস্ট টিমকে বাংলাদেশ ঘুরে দেখান তিনি।
তার অভিজ্ঞতা বলছে, বাংলাদেশে আসা প্রায় সব ট্যুরিস্টই পুরান ঢাকা ট্যুর করে থাকেন। এর মধ্যে তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে হিন্দু স্ট্রিট (শাঁখারি বাজার), পিংক প্যালেস (আহসান মঞ্জিল), সদরঘাট, লালবাগ ফোর্ট, তারা মসজিদ, আর্মেনিয়ান চার্চ, ঢাকেশ্বরী মন্দির।
এছাড়া নদীর ওপাড়ে গেলে খুব খুশি হন কেরানিগঞ্জ এর ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যস্ততা দেখে।
তিনি আরও জানান, পেডেল (Paddle) স্টিমার বিদেশি ট্রাভেলারদের কাছে আরেকটি আকর্ষণ। কয়েক দশকের পুরনো পেডেল স্টিমার ঢাকার সদরঘাট থেকে ছেড়ে বরিশাল হয়ে বাগেরহাট এর মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত যায়। পুরো জার্নিটা ওরা খুব উপভোগ করে।
উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, একবার এক বিদেশি কাপল স্টিমারে উঠে নেমেছে ৫ দিন পর। এই কদিন শুধু যাওয়া আসা করেছে।
৫ হাজারের বেশি বিদেশিকে বাংলাদেশে ট্রিপ প্ল্যান করে দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে তৃতীয় নম্বরে বিদেশিদের আকর্ষণের নাম সুন্দরবন। ট্যুরিস্টদের বেশ বড় একটি অংশই সুন্দরবন যায়। অনেকে স্টিমারে করে খুলনা গিয়ে সেখান থেকে সুন্দরবনের জাহাজে ওঠে।
চতুর্থ আকর্ষণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করছেন সিলেটের কথা। শান্ত আবহাওয়ার সিলেটের অন্যতম আকর্ষণ শ্রীমঙ্গল। ওখানকার চা বাগানগুলো ওদের কাছের খুবই পিসফুল মনে হয়, আর শ্রীমঙ্গলের ফাঁকা মসৃন রাস্তাকে ওরা বলে সাইক্লিং এর জন্য সেরা জায়গা।
আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, জেনি নামে এক বিদেশি ট্রাভেলার দেশে ফিরে ব্লগে লিখেছেন ‘Travelling in Bangladesh – Eight ‘Must Do’ Things ’ এর মধ্যে প্রথমেই ছিলো সেভেন লেয়ার টি অর্থাৎ শ্রীমঙ্গলের সাত রঙের চা। সেই আট জিনিসের কথা দেখতে ক্লিক করা যায় http://intrepid-girl.com/travelling-in-bangladesh-eight-must-do-things/
মাহমুদ আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামও পর্যটকের আগ্রহের স্থান। কিন্তু এখন কড়াকড়ির ফলে ভ্রমণ মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে।
শ্রীমঙ্গলের পরেই বলা যায় উত্তরবঙ্গের কথা। অনেক ট্যুরিস্টই সময় থাকলে রাজশাহী, বগুড়া এবং দিনাজপুর যান।
তবে দেশের পর্যটনে বরিশাল ব্যাক ওয়াটার ট্যুরের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এ নামটি অনেক বিদেশি ট্যুরিস্টই তাদের লিস্ট এ রাখেন। গত ১০ বছর ধরে আমি চেষ্টা করেছি বরিশালের খাল বিলগুলোকে প্রমোট করার জন্য। এখন আমার সে পরিশ্রমের কিছুটা রেজাল্ট পাচ্ছি। প্রতি মাসেই ২০-২৫ জন বিদেশি ট্যুরিস্ট যাচ্ছে বরিশালের ক্যানেলগুলোতে।
কক্সবাজারের বিষয়টি দু:খের সঙ্গে উল্লেখ করেন দেশীয় এই পর্যটন উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, আমি আবারও বলছি, খুব কম ট্যুরিস্টই কক্সবাজার যেতে চেয়েছেন।
এছাড়া মাহমুদ বলেন, আমাদের কাছে মজার কিছু জিনিস বিদেশি ট্যুরিস্টের কাছেও পর্যটন স্থান বিবেচিত হচ্ছে। যেমন, রিকশার ভাগাড়। পুলিশ অবৈধ রিকশা আটক করে মিরপুরের দিকে এক জায়গায় রাখে। বিদেশিরা এ জায়গার নাম দিয়েছে রিকশা গ্রেভ ইয়ার্ড। আর এটা দেখতে অনেকে যায়। এরপর আছে রিকশা পেইন্টিং। বংশালে রিকশা বানানো এবং রিকশার পেছনে আর্ট করার দোকানগুলোও অনেক বিদেশির পছন্দ।
এছাড়া বগুড়ার সারিয়া কান্দির কাছে যমুনা নদীর যে চর, সেটাও অনেক ট্যুরিস্টের কাছে আকর্ষণের বিষয়। কেউ ট্রেনের ছাদে মানুষ দেখতে টঙ্গী যায়। কেউবা কেবল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড দেখতেই যায় চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
এসএ/জেডএম