ত্রিপুরা, আগরতলা (ভারত) থেকে ফিরে: বাঙালির আতিথেয়তার জুড়ি মেলা ভার। চিরন্তন সে আতিথেয়তার প্রমাণ আরও গাঢ়ভাবে মেলে পূর্ব ভারতের বাঙালিদের বেলায়।
বাংলাদেশ থেকে অতিথি আসবেন জেনে গাড়ি নিয়ে হাজির ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলাবাসী। রাজধানী শহরে পূজার যানজট ঠেলে ঠিক সময়ে উপস্থিত তারা। সঙ্গে ফুল দিয়ে বরণও করে নিলেন। একে একে তুলতে ভুললেন না স্মৃতির ফ্রেমে বেঁধে রাখার ছবিও। পেশায় সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারা, সঙ্গে চাকরিজীবীও। তবে সব কাজ ফেলে যথাসাধ্য অতিথি বরণে মুগ্ধ করে দিলেন!
আকাশবাণীর উপস্থাপক সিদ্ধার্থ হালদার চলে আসেন সবার আগে। এসেই ঢুকে যান ভারতীয় আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন ভবনে। তাদের ইমিগ্রেশন ভবনটা আবার বেশ চমৎকার। একদম ধকধকে-তকতকে বিশাল ভবন। আর্চওয়ে, টাইলস, দামি কাঁচে ঘেরা চারপাশ, পর্যাপ্ত ফ্যান-লাইট, ব্যাগপত্র চেকিংয়ের পৃথক মেশিন- কী নেই সেখানে। এমন মনোরম পরিবেশে অতিথিদের সঙ্গে চট করে গল্প জমিয়ে ফেলেন সিদ্ধার্থ। গল্পের ছলে কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা বাতাসে বিশ্রাম শেষে বাইরে পা ফেলতেই দেখা যায় মিনি প্রাইভেটকার এসে হাজির। সরাসরি এলেন শান্তুনু শর্মা, যিনি মূলত ত্রিপুরা সফরে আমন্ত্রণের উদ্যোক্তা। এক কথায় এই মানুষটিকে সর্ব কাজের কাজী বললে ভুল হবে না বিন্দুমাত্র।
সারা সফরেই যিনি ছায়ার মতো অতিথি আপ্যায়ন করে গেছেন। যার মূলনীতি অতিথিদেবো ভব। এমনকি শহরের মধ্যে এদিক, সেদিক ঘোরাঘুরিতে নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন নিমিষে। শুধু তাই নয়, যে আবাসনে তিনি পুরো অতিথি দলকে রেখেছিলেন, সেখানকার প্রতিটি কক্ষই শীততপ নিয়ন্ত্রিত। এমনকি গোসলে সাবান-শ্যাম্পু পর্যন্ত আমন্ত্রিতদের নিজেই তদারকি করে সরবরাহ করেছেন শান্তুনু শর্মা।
আরেকজন দেবব্রত দেব রায়; লেখক, প্রাবন্ধিক। তার স্ত্রী সর্নিমা রায়, রাজ্যের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী। এই দম্পতির সঙ্গে পরিচয়টা আগে হয়নি। আগরতলা প্রেসক্লাবে এক মেঘলা বিকেলে কথা। সন্ধ্যায় আয়োজনস্থল থেকে বেরিয়ে চা, নাস্তা করিয়েই ছাড়লেন। সঙ্গে আড্ডা জমলো আধঘণ্টার মতো। তখনই মন্তব্যটা করতে ভুল হয়নি, অপরিচিত এতোগুলো মানুষকে মাত্র এক বিকেলের কথা-বার্তায় এতোটা আপন কীভাবে করে নিলেন বলুন তো!
শুধু কি তাই, এবার দাওয়াত পড়লো বাড়িতে। পরদিন সকালেই নাকি যেতে হবে। শত বলেও না করা যায় না। সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে ছিল গান-বাজনার আসর। ঝোল ঝোল আলুর দম, দুই পদের মিষ্টি আর লুচিতে পেট পুরে নাস্তা সেরে ফেলা। সেইসঙ্গে চা তো কমন পানীয়।
আর আমন্ত্রণকারী শান্তুনু শর্মার বাড়িতে বিনা হিসেব দাওয়াত তো সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগের রাত পর্যন্ত তিনি খাইয়েছেন। এছাড়া সকালে যখন ফেরার পালা সেদিনও আগমনের মতো নিজ গাড়িতে ব্যাগপত্র তুলে নিজেই চালিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন ইমিগ্রেশনে। সঙ্গে ছিল মায়ায় বাঁধা কিছু গিফটও।
আরেকদিনের কথা স্মৃতিতে বেশ টাটকা। শান্তুনু শর্মার উদ্যোগে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। স্থলনগরীর পোস্ট অফিস চৌমুহনী রাস্তা ধরে এইচজিবির নিউ চিত্রাকথা ভবনের এসকেএফ ফুড ওয়ার্ল্ড। রাত অব্দি সেখানে চলে গান এবং খাওয়া-দাওয়া। ভারতীয় একেকটি মেন্যুতে এক-এক প্লেট ভাত খেয়ে ফেলা যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে রাতে। আয়োজনের পুরোটাই হয় রেস্টুরেন্ট মালিক এবং শান্তুনু শর্মার যৌথ সদিচ্ছায়। বাংলাদেশ থেকে অতিথি এসেছেন, খাওয়াতে তো হবেই, এটাই যেন তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশি অতিথি হিসেবে আরও একটি সম্মানের কথা না বললেই নয়। শহরের মধ্য জয়নগরে ছিল আবাস, কক্ষ থেকে বেরিয়ে টুকিটাকি কিনতে সামনের মুদি দোকানে যাওয়া। সেখানকার দোকানির সঙ্গে আলাপ। কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আগত শুনে বলে বসলেন, পূজা আয়োজন চলছে, এমন সময় তাদের বাড়িতে যদি একটু বেড়িয়ে যাই তবে খুশি হতেন।
সত্যিই মন ভরে যাওয়ার মতো তার উক্তি! অচেনা মানুষকেও কী আপ্যায়নের আহ্বান। পুরো আগরতলাবাসীরই এমন আতিথেয়তা পরতে পরতে। তাদের আচরণ, সৌহার্দ্য কেবল মুগ্ধতাই ছড়াবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৬
আইএ/এইচএ/