দুপুরের ফ্লাইট ছাড়লো বিকেল পাঁচটারও কিছু পরে। কাঠমাণ্ডু পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা।
মেঘলা আবহাওয়া। ট্রেকিং শুরু করতেই আকাশ ভেঙে নামলো। বৃষ্টি সঙ্গে ছিলো পরবর্তী দু’দিনও। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রেসিডেন্ট এবং দু’বার এভারেস্ট আরোহণকারী প্রথম বাংলাদেশি এম এ মুহিত জানাচ্ছিলেন, মেরা অভিযানের শুরুর গল্প।
২১,২২৭ ফুট উচ্চতার মেরা পর্বত আরোহণ করার উদ্দেশ্য বিএমটিসির দল ঢাকা থেকে রওনা হয় ৪ অক্টোবর। দলে এম এ মুহিত ছাড়াও ছিলেন কাজী বিপ্লব, সাদিয়া সুলতানা ও শায়লা পারভীন বিথী।
অভিযাত্রী দল ৭ অক্টোবর লুকলা থেকে ট্রেকিং শুরু করে। সঙ্গে শেরপা হিসেবে ছিলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে সবচেয়ে কম সময়ে আরোহণকারী পেম্বা শেরপা। থুকদিংয়ে লাঞ্চের বিরতি নেওয়া হলো। সেখানকার উচ্চতা ৩,২০০ মিটার। সেখান থেকে চুতেংগাতে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আট তারিখ সকালে আবহাওয়া ভালোই ছিলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে খারাপ হতে লাগলো।
এর মধ্যেই ৪ হাজার মিটার উচ্চতার খারকাতেংয়ে বিরতি। নিজেদের বানানো আলু ভর্তা, ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেলাম। বড় গাছ গাছালি এখান থেকেই অদৃশ্য হলো। রুক্ষ প্রান্তরের মধ্য দিয়ে চললো হাঁটা। ৪,৮০০ মিটার উচ্চতার ছেত্রালা পাস অতিক্রম করতে হলো।
ট্রেকের দ্বিতীয় দিনেই একটু ভয় ছিলাম, পাছে কেউ উচ্চতাজনিত সমস্যায় পড়ে। কিন্তু সবাই ভালো মতোই পাস অতিক্রম করলো। এই পাসে উঠে আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করতে একঘণ্টা সময় লাগে। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। হোয়াইট আউটে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ৪,৩০০ মিটারের তুলি খারকা নেমে সেখানে রাতযাপন। পরদিন থাগনাগে পৌঁছে যাই।
১১ অক্টোবর ওখানেই থাকি। পরদিন ১২ অক্টোবর পৌঁছে গেলাম মেরা বেস ক্যাম্পে। সেখানকার উচ্চতা ৫,০৪৫ মিটার। পরের দিন রেস্ট ডে। আমরা একটু উপরে বরফে আরোহণের অনুশীলন করলাম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। আবহাওয়া ভালো হয়ে গেছে এর মধ্যে। তবে সাদিয়া সুলতানা শম্পা একটু স্লো হওয়ায় সিদ্ধান্ত হলো সে বেস ক্যাম্পে থেকে যাবে। মেরা পর্বতের বেস ক্যাম্প একটু উপরে। মেরা লা বলে একটি জায়গায় বরফের উপরে। আমরা একটু নিচে থাকার সিদ্ধান্ত নেই।
লুকলা থেকে মেরা বেস ক্যাম্পে আসাটাই বেশ কঠিন বিশেষ করে ছেত্রালা পাস অতিক্রম করতে অনেকে উচ্চতাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন। তবে এ পথের দৃশ্য এক কথায় অসাধারণ। এম এ মুহিত জানাচ্ছিলেন, বেস ক্যাম্প অবধি ট্রেক করার গল্প।
১৪ অক্টোবর অভিযাত্রী দল রওনা হয় হাইক্যাম্পের পথে। সকালে রওনা দিয়ে বেস ক্যাম্পে তারা পৌঁছায় বিকেলের দিকে। শেষ বিকেলের আলো ঠিকরে পড়ছিলো এভারেস্ট, লোৎসের গায়ে। এম এ মুহিতের ভাষ্যে, মেরার হাইক্যাম্প থেকে পৃথিবীর আট হাজার মিটারের পাঁচটি পর্বত দেখা যায়। এগুলো হলো এভারেস্ট, লোৎসে, মাকালু, চোয়ু এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এভারেস্ট এবং চোয়ুর দিকে চোখ পড়তেই শিহরণ খেলে গেলো। একসময় আমিও ওই দুই পর্বত শিখরে পা রেখেছিলাম। সিদ্ধান্ত হলো রাতেই সামিটের উদ্দেশ্যে বের হবো। ফলে সন্ধ্যের মধ্যেই শুয়ে পরি। কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। তন্দ্রার মতো পরে রইলাম।
রাত ১২টার দিকে পেম্বার ডাকে সবাই উঠে পরলাম। কিছু মুখে দিয়ে পুরো প্রস্তুত হয়ে বের হতে হতে রাত পৌনে দু’টা বেজে গেলো। ওইদিন ছিলো পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় পথ চলছি ধবল পাহাড়ের বুক চিড়ে। এখন কেবলই উঠে যাওয়া। ৫০, ৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছিলো। যদিও এরচেয়েও বেশি বাতাসের মুখোমুখি হয়েছি এর আগে। ভোরের প্রথম আলোর ছটা লাগলো দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে। সামিটের আগে ৬০ মিটার জায়গা বেশ খাড়াই। সেখানে দঁড়ি লাগিয়ে জুমারের সাহায্যে আরোহণ শুরু হলো। আমাদের দলের নতুন অভিযাত্রী শায়লা পারভীন বিথী সবার আগে চলেছে। গোটা অভিযানেই নতুন হিসেবে তার পারফরমেন্স খুবই ভালো ছিলো। সকাল ৭টা ২০ মিনিটে আমরা মেরা সামিটে পৌঁছালাম।
এখানে একটু বলি, মেরা সামিটে জায়গাটা বেশ ঢালু। কারণ এর উপরের অংশ কার্নিশের মতো। নীচে কিছু না থাকায় এখানে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। ফলে চার পাঁচ হাত নিচেই দাঁড়াতে হলো। জাতীয় পতাকা, ক্লাব এবং স্পন্সরদের পতাকা নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে পনেরো বিশ মিনিট। এরপর রওনা দিলাম ফিরতি পথে। আমরা ওইদিনই বেস ক্যাম্পে নেমে আসি। ১৮ অক্টোবর পৌঁছে যাই লুকলা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৬
জেডএস